প্রাক-পুঁজিবাদী যুগে রাজা-বাদশারাই দেশ শাসন করতেন। কোন সংবিধানের অধীনে এই শাসন চলতো না। প্রত্যেক দেশের সমাজ ব্যবস্থায় তাদের নিজস্ব কিছু প্রচলিত নিয়মকানুন, রীতিনীতি ছিল। সেই নিয়মকানুন, রীতিনীতির সাথে শাসক রাজা-বাদশাদের দ্বারা নির্দিষ্ট ও প্রচলিত আইনকানুন যুক্ত হয়ে আইনের একটা কাঠামো থাকতো। সেই কাঠামোর অধীনেই রাজা-বাদশারা শাসন কাজ পরিচালনা করতেন। তবে আইনের এই কাঠামো এমন হতো না, যা রাজা-বাদশারা পবিত্র জ্ঞানে সব সময় মান্য করতেন। কাজেই এর লঙ্ঘন প্রায়ই ঘটতো, কারও ক্ষেত্রে কম, কারও ক্ষেত্রে বেশী। আইনের এই লঙ্ঘনকেই বলা হতো স্বেচ্ছাচারিতা (despotism)। এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা প্রাক-পুঁজিবাদী রাজা-বাদশাদের যুগে ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার।
পুঁজিবাদের আবির্ভাব ও তার বিকাশ ঘটতে থাকার সাথে সাথে সমাজের সর্বক্ষেত্রে শৃংখলার প্রয়োজন বেশী করে দেখা দেয়। এই শৃংখলা রক্ষার জন্য প্রয়োজন হতে থাকে নোতুন নোতুন আইনকানুনের। স্বেচ্ছাচারী রাজা-বাদশারা ছিলেন সামন্তবাদী শাসক। সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা ও তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে বিন্যস্ত সমাজ সম্পর্কের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ থাকতো। এই স্বেচ্ছাচারিতার অর্থ বাস্তবতঃ ছিল রাষ্ট্রশক্তির অধিকারীদের জবাবদিহিতার কোন আইনগত ব্যবস্থা না থাকা, তাদের নিজেদের স্বার্থে জনগণের ওপর ইচ্ছেমত হামলা করা, তাদেরকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা, ব্যক্তি স্বাধীনতার বিকাশ রুদ্ধ করা।
এই সমাজ কাঠামো ভেঙেই পুঁজিবাদ নিজের বিকাশ ঘটাতে শুরু করে। স্বেচ্ছাচারিতার অবসান এই বিকাশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এর জন্য প্রয়োজন হয় জবাবদিহিতার এবং জবাবদিহিতার জন্য কার্যতঃ প্রয়োজন হয় এমন আইন যার দ্বারা সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্র শাসিত হবে, যাকে মান্য করে চলা সমাজে সকলের জন্যই হবে বাধ্যতামূলক। পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়ায় অনির্বাচিত রাজা-বাদশাদের ক্ষমতা কমে আসতে থাকে। ক্রমশঃ দেশের পর দেশে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ অথবা কার্যকরভাবে উচ্ছেদ হতে থাকে। রাজতন্ত্রই ছিল স্বেচ্ছাচারিতার সর্বোচ্চ রূপ। স্বেচ্ছাচারিতার অবসান ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই শাসন ব্যবস্থায় উদ্ভব ঘটে শাসনতন্ত্র বা সংবিধানের।
সংবিধান হলো, রাষ্ট্রের মৌলিক আইন যার কাঠামোর মধ্যে প্রণীত হয় অন্যান্য আইন। এর অর্থ যে কোন আইনকেই এই কাঠামোর অন্তর্গত ও এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। কারও অধিকার থাকবে না এই কাঠামোর বাইরে আইন প্রণয়ন করা অথবা এর অন্তর্গত কোন আইন ভঙ্গ করা। অর্থাৎ কেউ এ কাজ করলে তাকে জবাবদিহি করতে হবে, এ কাজ স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে বিবেচিত হবে এবং এর জন্য শাস্তি পেতে হবে।
শুধু পুঁজিবাদই নয়, সংগঠিত যে কোন আধুনিক ব্যবস্থাতেই সংবিধান হলো, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। এ কারণে পুঁজিবাদের থেকে উন্নততর ব্যবস্থা সমাজতন্ত্রেও সংবিধানে আরও কঠোরভাবে জবাবদিহিতা কার্যকর এবং আইনের শাসন পরিচালনার ব্যবস্থা থাকে।
দুই
১৯৭১ সালে বাঙলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এ দেশের সংবিধান প্রণীত হয়। কিন্তু যেভাবে এই সংবিধান প্রণীত ও তৎকালীন জাতীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত হয় তার দ্বারাই সংবিধান প্রণয়নের রীতিনীতি গুরুতরভাবে, বলা চলে মৌলিকভাবে, লঙ্ঘিত হয়েছিল। সংবিধান প্রণয়ন কোন খামখেয়ালী বা ছেলে খেলার ব্যাপার নয়। যেহেতু স্বেচ্ছাচারিতার অবসান সাংবিধানিক শাসনের প্রধানতম উদ্দেশ্য সে কারণে সংবিধান প্রণয়নের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পদ্ধতি হলো, সরাসরি জনগণের ভোটের মাধ্যমে শুধু সংবিধান প্রণয়নের জন্যই একটি সংবিধান সভার নির্বাচন। পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছিল। সে জাতীয় সংসদের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি নোতুন সংবিধান প্রণয়ন। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বার বার বলেছিলেন যে, ছয় দফা ও এগারো দফার ভিত্তিতেই নোতুন সংবিধান নির্মিত হবে। ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারী তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) শেখ মুজিব নিজে কোন শপথ গ্রহণ না করলেও [!] তিনি জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্যদের এক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন। তাঁরা এই মর্মে শপথ গ্রহণ করেছিলেন যে, জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ছয় দফা ও এগারো দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে তাঁদেরকে নির্বাচিত করেছেন এবং তাঁরা সেই ভিত্তিতেই সংবিধান রচনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। বলাই বাহুল্য যে, ছয় দফা ও এগারো দফার ভিত্তিতে আত্মনিয়ন্ত্রণের এই ব্যবস্থা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কোন প্রশ্ন সেখানে ছিল না, স্বাধীন বাঙলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কোন চিন্তা করে জনগণ সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট প্রদান করেন নি। নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদকে সে সময় ছয় দফা ও এগারো দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনার যে ম্যান্ডেট বা এখতেয়ার দেওয়া হয়েছিল সেটা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে এমন একটি সংবিধান প্রণয়ন যাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার স্বীকৃতি হবে।
কোন রাষ্ট্রের একাধিক অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে রচিত সংবিধান এবং একটি স্বাধীন দেশের সংবিধান এক জিনিস নয়। শুধু তাই নয়, একটি দেশ বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে স্বাধীন হওয়ার পর সেই স্বাধীন দেশের নোতুন সংবিধান রচনার ঘোষিত লক্ষ্যকে সামনে রেখে নোতুন নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই সংবিধান সভা হিসেবে এই দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এইভাবে প্রাপ্ত দায়িত্ব বা এখতেয়ার ব্যতীত একটি স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নের কোন গণতান্ত্রিক বৈধতা অন্য কোন ধরনের সংসদেরই নেই।
এসব চিন্তা না করে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য যে জাতীয় সংসদ নির্বাচিত হয়েছিল সেই সংসদের সাথে একই সময়ে নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সংসদকে যুক্ত করে উভয় সংসদের সদস্যদেরকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাঙলাদেশের জাতীয় সংসদ। এইভাবে গঠিত জাতীয় সংসদেই স্বাধীন বাঙলাদেশের খসড়া সংবিধান উপস্থিত করা হয়েছিল। এই সংসদই সেই খসড়া অনুযায়ী প্রণয়ন করেছিল বাঙলাদেশের সংবিধান।
১৯৭০ সালে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সমন্বয়ে গঠিত পার্লামেন্টের অধীনে সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে একটি নোতুন সংবিধান সভার জন্য কোন নির্বাচন অনুষ্ঠান না করার মধ্যে যে অবৈধতা ও ক্ষমতাসীনদের বেপরোয়া এবং ঔদ্ধত্য ছিল তার দ্বারাই ১৯৭২ সালের সংবিধান খুব স্পষ্টভাবেই চিহ্নিত হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয় ও সরকারী ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রকৃতপক্ষে স্বেচ্ছাচারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, নোতুন সংবিধান সভা গঠনের জন্য নির্বাচন দেওয়া অর্থহীন, কারণ সে সময় নির্বাচন দিলে তাঁরাই নির্বাচিত হবেন ও সংবিধান সভা গঠন করে সংবিধান তৈরী করবেন। কাজেই নোতুন নির্বাচনের মাধ্যমে নোতুন সংবিধান সভা গঠনের কোন প্রয়োজন নেই! এর মধ্যে শেখ মুজিবের চিন্তার যে বিপজ্জনক সীমাবদ্ধতার দিকটি স্পষ্ট হয়েছিল তা হলো, পাকিস্তান আমলের পূর্ব বাঙলা বা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে স্বাধীন বাঙলাদেশের পার্থক্য বোঝার ক্ষেত্রে তাঁর অক্ষমতা। তাঁর এই উপলব্ধির অভাবের মূল কারণ ছিল, ১৯৭১ সালে নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তাঁর নিজের কোন প্রত্যক্ষ ভূমিকা না থাকা। শুধু তাই নয়, তাঁর এই ভূমিকার অভাব, তাঁর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও স্বাধীন বাঙলাদেশের সৃষ্টি, যা তিনি ১৯৭১ সালে মার্চ মাসেও অনেক বাগাড়ম্বর করা সত্ত্বেও বিশ্বাস করতে অপারগ ছিলেন, তাঁর মধ্যে এমন নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, তাঁর অহমিকাতে এমন আঘাত করেছিল যাতে তিনি ১৯৭১ সালে কি ঘটেছিল তার বিবরণ জানার কোন চেষ্টাই করেন নি। তাঁকে তাজউদ্দিন প্রভৃতি অন্যরা সেটা জানানোর চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি তা শোনেননি, শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না। অহমিকাজনিত কারণে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘটনাবলী ও বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে নিজেকে অনবহিত ও অজ্ঞ রাখার এই সিদ্ধান্ত তাঁর, তাঁর দলের ও দেশের প্রভূত ক্ষতি করেছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তাঁর সরকার উচ্ছেদ হওয়ার কারণও অনেকাংশে এর মধ্যেই নিহিত ছিল। নোতুন নির্বাচনের মাধ্যমে নোতুন সংবিধান সভা গঠন না করে পাকিস্তান আমলে গঠিত জাতীয় সংসদকে দিয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন ছিল তাঁর স্বেচ্ছাচারী ও নানা ভ্রান্ত কাজের অন্যতম প্রধান দৃষ্টান্ত।
যেভাবেই হোক, একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রক্রিয়ায় রাজনীতির ক্ষেত্রে যে সব নোতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটেছিল ও সংবিধান রচনার ক্ষেত্রেও তাদের যে প্রতিনিধিত্বমূলক ভূমিকার প্রয়োজন ছিল তার গুরুত্ব উপলব্ধি শেখ মুজিবের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কাজেই তার কোন হিসেবও তাঁর ছিল না। কমিউনিস্ট নামধারী যে বামপন্থীরা আওয়ামী লীগের তল্পিবাহক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিলেন এ ব্যাপারে তাঁদেরও কোন উপলব্ধি ছিল না। কাজেই স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সব নোতুন রাজনৈতিক উপাদান সংবিধান রচনাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদান রাখার কথা ও যাঁদের প্রতিনিধিত্বের জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সংবিধান সভার নোতুন নির্বাচন দরকার ছিল তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পাকিস্তানী জাতীয় সংসদকে দিয়ে ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাঙলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল। নোতুন সংবিধান সভা, যা নোতুন সংবিধানের অধীনে নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ হিসেবেও কাজ করতো, তার গঠনের আগে পর্যন্ত পুরাতন জাতীয় সংসদ সরাসরি কাজ চালিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু তাকে দিয়ে নোতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজ করিয়ে নেওয়ার মধ্যে যেমন কোন বৈধতা ছিল না, তেমনি ছিল না কোন রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয়। শুধু তাই নয়, এভাবে সংবিধান প্রণয়নের মধ্যে যে স্বেচ্ছাচারিতা ও দেউলিয়াপনা ছিল তার দ্বারাই বাঙলাদেশের পরবর্তী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে দেশে এক অরাজক ও সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে ১৯৭৫ সালে আওয়ামী বাকশালী শাসনই উচ্ছেদ হয়েছিল।
ভারতে ও পাকিস্তানে স্বাধীনতার পর সংবিধান প্রণয়নের জন্য নোতুন নির্বাচনের প্রয়োজন ছিল না। কারণ ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ আমলে নির্বাচনের মাধ্যমে যে পার্লামেন্ট গঠিত হয়েছিল তার ঘোষিত লক্ষ্যই ছিল ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রণয়ন। ভারত বিভক্ত হলে ১৯৪৬ সালে নির্বাচিত পার্লামেন্ট দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত দুই অঞ্চলে দুই পৃথক রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের জন্য স্বতন্ত্রভাবে গঠিত হয়েছিল।
তিন
১৯৭২ সালের সংবিধানের নোতুন সংশোধনীর জন্য এখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের অনেক তোড়জোড় চলছে। এসব সংশোধনীর উদ্দেশ্য হলো, ১৯৭২ সালের সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যহীন সংশোধনীগুলি বাতিল করে মূল সংবিধানের বিশুদ্ধতা রক্ষা, সেই সংবিধানকে তার “পূর্র্ব গৌরবে” প্রতিষ্ঠা করা! এছাড়া এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, সংবিধানের মধ্যে এমন সংস্থান রাখা যাতে ভবিষ্যতে বাঙলাদেশে কোন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সামরিক শাসন কায়েমের পথ আইনগতভাবে রুদ্ধ হয়!! এই উভয় উদ্দেশ্যই যে অবাস্তব ও উদ্ভট এবং তা সফল হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়, এ বিষয়টি প্রথমে আলোচনা করা দরকার।
সংবিধান হলো একটি দেশের মৌলিক আইন যার কাঠামোর মধ্যে ও যার সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য আইন প্রণীত হয়ে থাকে। এই মূল আইন বা সংবিধান দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এ জন্য রাষ্ট্রের সাথে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রের চরিত্রই নির্ধারণ করে দেশের সংবিধানের চরিত্র। রাষ্ট্র যে সকল স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে ও যে সকল স্বার্থ রক্ষা করে, সেই স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব ও রক্ষা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানের নির্ধারিত কাজ। কাজেই রাষ্ট্রের চরিত্রই এ ক্ষেত্রে মৌলিক। সংবিধানের চরিত্র রাষ্ট্রের চরিত্র কাঠামোর দ্বারাই সর্বতোভাবে নির্ধারিত হওয়ার কারণে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে যেমন সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান পরিবর্তিত হয়ে থাকে, তেমনি সংকটজনক ও জরুরী পরিস্থিতিতে প্রচলিত সংবিধান রাষ্ট্রীয় শক্তির স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে সংবিধান উচ্ছেদের ঘটনাও ঘটে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফেরত যাওয়া এবং রং বেরং-এর সামরিক অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন অপরিহার্য।
চার
প্রথমেই মনে রাখা দরকার যে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারতে, পাকিস্তানে এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাঙলাদেশে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছে সেই সব সংবিধান ব্রিটিশ আমলে, অর্থাৎ স্বাধীনতার আগে দুশো বছর ধরে যে সব আইন প্রচলিত ছিল সেগুলি সব বাতিল করে নি। শুধু তাই নয়, নোতুন সংবিধানে সেই সব আইন স্বীকৃত থাকার কারণে এখনো সেগুলি দ্বারা স্বাধীন রাষ্ট্রের অনেক কাজই ভারত, পাকিস্তান, বাঙলাদেশে পরিচালিত হয়ে থাকে। এর দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, ব্রিটিশ ও পরবর্তী আমলে যে সকল শক্তি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে তাদের মধ্যেকার নাড়ীর সম্পর্ক ছিন্ন হয় নি। অর্থাৎ ব্রিটিশ আমল ও পরবর্তী স্বাধীন আমলের রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্যে একটা ঐক্য আছে যে ঐক্য আইনের ধারাবাহিকতার মাধ্যমেই রক্ষিত হয়।
রাষ্ট্রের চরিত্রের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, তার শ্রেণী চরিত্র। পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক যে রাষ্ট্রই হোক, তার শ্রেণী চরিত্র থাকে, অন্ততঃ তাতে পুঁজি স্বার্থ অথবা শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থ নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে, দেশে দেশে প্রচলিত পুঁজিবাদী বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যেও পার্থক্য থাকে। সমাজের বিকাশের পর্যায় অনুযায়ী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে সামন্তবাদী স্বার্থ এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুঁজিবাদী স্বার্থ, তুলনায় গৌণ হলেও, একটা ভূমিকা পালন করে। এ কারণেই দুনিয়ার বিভিন্ন পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চরিত্র হুবহু এক হয় না। তার মধ্যে ভিন্নতা থাকে।
পাঁচ
যাঁরা বাঙলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক বাগাড়ম্বর করেন, স্বাধীনতা-উত্তর পরিস্থিতি ও বাঙলাদেশের সংবিধান নিয়ে আলোচনা করেন, তাঁদেরকে বাঙলাদেশের শাসক শ্রেণীর চরিত্র, তাঁদের শ্রেণী চরিত্র নিয়ে কোন কথা বলতে শোনা যায় না। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে, এ বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর শাসক শ্রেণী হিসেবে যারা আবির্ভূত হয় তাদের চরিত্রের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল যা রীতিমত বিপজ্জনক। এই বিপদ এমন, যা একটি সুগঠিত শোষক শ্রেণী, উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত শাসক শ্রেণীর শাসনের মধ্যে দেখা যায় না।
১৯৭১ সালে বাঙলাদেশে আওয়ামী লীগ শুধু সরকারী ক্ষমতায় নয়, রাষ্ট্র ক্ষমতাতেই অধিষ্ঠিত হয়েছিল। এই শাসক দল ১৯৪৯ সাল থেকে এক ধরনের রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে থাকলেও তারা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাঙলা বা পাকিস্তানের কোন ধরনের উৎপাদনশীল শক্তির প্রতিনিধিত্ব করতো না। এই পুরো সময়টা আওয়ামী লীগ যেমন কৃষক শ্রমিকসহ অন্য কোন উৎপাদনশীল শোষিত শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে নি, তেমনি তারা কাজ করতে পারে নি এখানকার ভূমি মালিক এবং শিল্প ব্যবসা মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে। এর কারণ এক দিকে যেমন তারা ছিল সামাজিক অবস্থান ও লক্ষ্য আদর্শের ক্ষেত্রে শ্রমজীবীদের সাথে সম্পর্কহীন, তেমনি অন্যদিকে ভূমি মালিক এবং শিল্প ব্যবসা মালিকরা পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক শাসক শ্রেণীর সাথে নানা সূত্রে সম্পর্কিত থাকার কারণে তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোন শ্রেণীগত অবস্থান গড়ে ওঠে নি। সে অবস্থান তৈরী করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। গ্রামীণ শোষক ও বুর্জোয়া শ্রেণী প্রথম দিকে মুসলিম লীগ ও পরে আইউব খানের শাসন প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত ছিল। এ অঞ্চলে যে বাঙালীরা শিল্প ব্যবসা ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান তৈরী করছিল তারা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার কারণে তারা আওয়ামী লীগ রাজনীতির মধ্যে নিজেদের কোন সম্ভাবনা ১৯৬৯-১৯৭০ সাল পর্যন্ত দেখে নি। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের খুঁটিতেই বাঁধা ছিল। পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল তাতে কমিউনিস্টসহ কিছু কিছু পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখলেও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগই সেই প্রতিরোধের মূল শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু এই প্রতিরোধ সংগ্রামের বৈশিষ্ট্য এমনই ছিল যে, তাতে দেশের উৎপাদনশীল জনগণের প্রতিনিধির পরিবর্তে অনুৎপাদনশীল লোকজনেরই প্রাধান্য স্থাপিত হয় এবং তাদের প্রতিনিধি হিসেবেই আওয়ামী লীগ নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। নব্য বাঙালী শিল্প ব্যবসায়ী বুর্জোয়া শ্রেণীর আকার ছোট হলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে শ্রেণী স্বার্থের গাঁটছড়ায় তাদের প্রধান অংশ বাঁধা থাকা এবং এখানকার প্রতিরোধ সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাই ছিল এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এর ফলে আওয়ামী লীগের গঠন (Composition) এর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, এই সংগঠনের নেতৃত্ব ছিল পাটের দালাল, বীমার দালাল, উকিল-মোক্তার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ভূমি মালিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষক, বেকার যুবক ও ছাত্রদের হাতে। নোতুন একটি রাষ্ট্রে ক্ষমতার অধিকারীদের এই ধরনের শ্রেণী চরিত্র ছিল এক অতি ব্যতিক্রমী ব্যাপার। এর তূল্য কোন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।
এই বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এর দ্বারাই নোতুন বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র নির্মিত হয়েছিল এবং ১৯৭১ পরবর্তী যা কিছু এ দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ঘটেছে তার মূল কারণ এর মধ্যেই নিহিত আছে।
ছয়
রাষ্ট্রের রাজনৈতিক উপরিকাঠামো (Superstructure) তার অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপরই গঠিত হয়। শুধু রাজনৈতিক নয়, রাষ্ট্রের সমগ্র উপরিকাঠামোই মূলতঃ দাঁড়িয়ে থাকে তার অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর। কিন্তু রাষ্ট্র পরিবর্তনের সময় তার মধ্যে যে ভাঙন দেখা যায় তাতে সাময়িকভাবে ভিত্তি এবং উপরিকাঠামোর মধ্যেকার এই সম্পর্কের মধ্যে পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ায় যেমন অর্থনীতি রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রে মৌলিক ও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি রাষ্ট্র পরিবর্তনের সময় রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্থনীতিসহ অন্য সব ক্ষেত্রের ওপর সব থেকে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। যে রাষ্ট্রবিপ্লবে এক শ্রেণীর পরিবর্তে অন্য শ্রেণীর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা হয় সেখানে এই পরিবর্তন খুব মৌলিক, ব্যাপক ও গভীর হয় কারণ এর মাধ্যমে রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্রই পরিবর্তিত হয়। আবার যেখানে রাষ্ট্রবিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা শ্রেণী সম্পর্ক অটুট রেখে ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়, জাতি বা আঞ্চলিক শক্তির হস্তগত হয় সেখানে ভিন্নভাবে ও নিু মাত্রায় একই ব্যাপার ঘটে। বাঙলাদেশে ১৯৭১ সালে এই দ্বিতীয় ধরনের পরিবর্তনই ঘটেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার সময় ক্ষমতা ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতে হিন্দু প্রধান ভূমি মালিক ও বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছে এবং পাকিস্তানে মুসলমান প্রধান ভূমি মালিক ও বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছে হস্তান্তরিত হয়েছিল। বাঙলাদেশেও ১৯৭১ সালে এ ধরনের ব্যাপারই ঘটেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক কেন্দ্রীয় সরকারের এবং পাঞ্জাবী ভূমি মালিক ও বুর্জোয়াদের থেকে ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের হাতে এসেছিল।
এই বাঙালীরা কারা ছিল? কি ছিল তাদের শ্রেণী চরিত্র? এ প্রশ্ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলেও শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন দলের নেতা, তাদের ঘরাণার বুদ্ধিজীবী থেকে নিয়ে কমিউনিস্ট নামধারী বামপন্থীরা কেউই তা উত্থাপন করে নি। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্র ও সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই আওয়ামী লীগের শ্রেণী চরিত্র কি ছিল এ প্রশ্ন তো কেউ করেই-নি, উপরন্তু তাদের কোন নির্দিষ্ট শ্রেণী চরিত্র থাকতে পারে, এ ধারণাও অনেক বুদ্ধিজীবীর ছিল না। তাঁরা মনে করতেন আওয়ামী লীগ দেশের স্বাধীনতা এনেছে এবং তারা এমন এক জাতীয় পার্টি যা সকলেরই প্রতিনিধিত্ব করে। কমিউনিস্টরা আওয়ামী লীগের প্রকৃত শ্রেণী চরিত্র অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে তাকে শুধু ভূমি মালিক জোতদার ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর দল হিসেবে আখ্যায়িত করে নিজেদের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের কাজ সমাধান করতেন। তার মধ্যে ইতিবাচকের থেকে নেতিবাচক উপাদানেরই প্রাধান্য থাকতো।
বাঙলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর, অর্থাৎ একটি রাষ্ট্র সামগ্রিকভাবে না হলেও একটি অংশে উচ্ছেদ হয়ে যেভাবে অন্য একটি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছিল, সে প্রক্রিয়ার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য ছিল। এই বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্যক পরিচয় ছাড়া বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের প্রকৃত চরিত্র এবং ১৯৭১ পরবর্তী ঘটনাবলীর পরম্পরা বোধগম্য হওয়া সম্ভব নয়।
এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ১৯৭১ সালের রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর কোন নির্দিষ্ট শ্রেণী অর্থাৎ উৎপাদনের সাথে সম্পর্কিত শ্রেণী, যেমন ভূমি মালিক, শিল্প ব্যবসা বাণিজ্য মালিকের কাছে হয় নি। এ হস্তান্তর হয়েছিল এমন একটি রাজনৈতিক দলের কাছে, যারা ছিল উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন, প্রধানতঃ মধ্যস্বত্বভোগীদের দ্বারা গঠিত। এদের চরিত্রের বিষয় ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাত
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাঙলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঠিক পর পরই এখানে যা ঘটতে থাকে তার দিকে তাকালেই এই রাষ্ট্রের ক্ষমতা শ্রেণীগতভাবে কাদের হাতে ছিল ও কাদের হাতে ছিল না তার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথম থেকেই চারদিকে লুটপাটের এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। শুধু অবাঙালীদের বাড়ীঘর, জমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, আফিস, শিল্প কারখানাসহ সকল প্রকার সম্পত্তিই নয়, সেই সাথে পাকিস্তানীদের সহযোগী ও সহযোগী বলে সন্দেহভাজন বাঙালীদের সম্পত্তিও এইভাবে লুটপাট হতে থাকে। অনেকে শুধু লুটপাট করার জন্যই নিরীহ লোকজনকে পর্যন্ত পাকিস্তানীদের সহযোগী রাজাকার, আল বদর ইত্যাদি হিসেবে অভিহিত করে তাদের সম্পত্তি দখল করে।
যেভাবে এই লুটপাট ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হয়ে দেশের সর্বত্র দীর্ঘদিন ধরে একইভাবে চলেছিল তার থেকেই বোঝা যায় যে, রাষ্ট্র শক্তির জোরে যারা এ কাজ করছিল তাদের চরিত্র মূলতঃ ল্ণ্ঠুনকারী, যারা কোন উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। লুম্পেন চরিত্রসম্পন্ন এই শ্রেণীর লোকরাই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও পুরো শরীর গঠন করেছিল।
যারা ১৯৭২ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বাঙলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু করেছিল তাদের কর্ম পদ্ধতির সাথে এই লুণ্ঠনজীবীদের কর্মপদ্ধতির ঐক্য সহজেই লক্ষ্যণীয়। আগেই কথা হয়েছে, কিভাবে সংবিধান প্রণয়নের জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি নোতুন সংবিধান সভা নির্বাচনের পরিবর্তে তারা পাকিস্তানী আমলে নির্বাচিত পাকিস্তানের জাতীয় ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমন্বয়ে সংবিধান সভা গঠন করে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল। এ কাজ করতে গিয়ে তাদের বহুকথিত একাত্তরের চেতনাসম্পন্ন নোতুন রাজনৈতিক শক্তিকে নিজেরাই সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে বা বাতিল করে স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করেছিল!
১৯৭২ সালের সংবিধানে কিছু গণতান্ত্রিকক উপাদান ছিল। কাজেই আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয় যে, এই সংবিধানের প্রণেতারা প্রকৃতই গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছিল যে, যতটুকু গণতান্ত্রিক চরিত্র এই সংবিধানের শরীরে ছিল তার সাথে সংবিধান প্রণেতাদের, বিশেষতঃ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর সহকর্মীদের শ্রেণীগত চারিত্রিক কোন সম্পর্ক ছিল না। জনগণকে প্রতারিত করার জন্যই সংবিধানে কিছু গণতান্ত্রিক ধারা সন্নিবেশিত হয়েছিল। এ সংবিধান প্রবর্তিত হওয়ার পর অল্পদিনের মধ্যেই তা যেভাবে সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয়েছিল তার দ্বারাই নব্য শাসক শ্রেণীর সরকারী দল আওয়ামী লীগ তার প্রতারক চরিত্র উন্মোচন করেছিল। এর মধ্যে দ্বিতীয় ও চতুর্থ সংশোধনী, বিশেষতঃ চতুর্থ সংশোধনীটি ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধানের মধ্যে যা কিছু গণতান্ত্রিক উপাদান ছিল তার মূলে কুঠারাঘাত করে তাকে ধ্বংস করেছিল। এই সংশোধনীর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ডান হাতে যা দেওয়া হয়েছিল সেটা বাম হাতে অপহরণ করা হয়েছিল। এর থেকে বড় প্রতারণার দৃষ্টান্ত অন্য কোন দেশের সংবিধানের ইতিহাসে নেই।
তবে আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালের মধ্যেই সংবিধানের যে দুরবস্থা ঘটিয়েছিল সেটা যে অবশ্যম্ভাবী ছিল এটা আমরা তার খসড়া সংবিধান সভায় প্রস্তাবিত হওয়ার পরই তার ওপর আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলাম। ‘আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত সংবিধান’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে ১৯৭২ সালের ২৯শে অক্টোবর মাসে আমি লিখেছিলাম, “সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রস্তাবিত শাসনতন্ত্রটিতে রাষ্ট্র পরিচালনা মূলনীতি হিসেবে ঘোষিত হলেও একটা প্রাথমিক বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে যে, বস্তুতপক্ষে এই শাসনতন্ত্রটি উপরোক্ত চারটি মূলনীতির বিরুদ্ধেই সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত,” (সাপ্তাহিক স্বাধীকার, বদরুদ্দীন উমর, যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশ, পঞ্চম প্রকাশ, ১৯৯৭ আফসার ব্রাদার্স, ঢাকা)। এই বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রস্তাবিত সংবিধানের বিভিন্ন ধারা পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছিল। দেখানো হয়েছিল, কিভাবে সেগুলোর মধ্যে এমন সব ধারা সংযোজিত হয়েছিল যার দ্বারা মূল নীতিগুলোকে বিধ্বস্ত করার ব্যবস্থাই করা হয়েছিল। সংবিধানের এই পরিণতি ঘটতে দেরী হয়নি। ১৯৭৫ সালের মধ্যেই চারটি সংশোধনীর মাধ্যমে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী-বাকশালী সরকার একটি ফ্যাসিস্ট সরকার হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়ে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। এর বিস্তারিত বিবরণের মধ্যে যাওয়ার প্রয়োজন আমাদের বর্তমান আলোচনায় নেই, এ আলোচনা বিস্তারিতভাবে অন্যত্র করা হয়েছে।
আট
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর থেকে সংবিধান সংশোধন করে ১৯৭২ সালের সংবিধানকে তার “পূর্ব গৌরবে” প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নানা তৎপরতা দেখাচ্ছে। এ নিয়ে তাদের অর্ধশিক্ষিত নেতানেত্রী থেকে নিয়ে তাদের ঘরাণার বুদ্ধিজীবীরা সভাসমিতিতে কথা বলছেন ও পত্র-পত্রিকায় রচনা লিখছেন। তাঁদের এই কাজ থেকে মনে হয় তাঁরা সত্যিসত্যিই ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানকে তার আদি রূপে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর!
প্রথমেই বলা দরকার যে, এই চিন্তা যাঁরা করছেন তাঁদের অধিকাংশেরই ১৯৭২ সালের সংবিধানের সাথে পরিচয় নেই। তাঁরা জানেন না যে, ঐ সংবিধানের মূল শরীরে কি ছিল এবং পরে তার থেকে কি কি বাতিল হয়ে সংবিধান বর্তমানে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যা বাস্তবতঃ অকার্যকর হওয়ায় ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফেরত যাওয়ার হুজুক এখন আওয়ামী মহলে জোরদার হয়েছে। এই সুযোগে এই মহলের ধুরন্ধর লোকেরা বলে বেড়াচ্ছেন যে, জিয়াউর রহমানের সময় কৃত পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যেই সংবিধান তার আদিরূপে বহাল হয়েছে। শুধু কামাল হোসেনের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠিত সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবীই নয়, সদ্য নিযুক্ত সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত শপথ গ্রহণের পরপরই বলেছেন এই একই কথা!
নয়
এক্ষেত্রে যে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বুঝতে হবে তা হলো, ১৯৭২ সালে যে সংবিধান তৈরী করা হয়েছিল তার মধ্যে যা কিছু গণতান্ত্রিক উপাদান ছিল তার সাথে সংবিধান রচয়িতা শ্রেণীর স্বার্থের কোন যোগ ছিল না। উপরন্তু সেই সংবিধানের সাথে সংবিধান রচয়িতাদের যে দ্বন্দ্ব ছিল তার বহিঃপ্রকাশ অল্পদিনের মধ্যেই তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে সামনে এসেছিল। এই দ্বন্দ্বের সমাধান শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী-বাকশালী সরকার করেছিল সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে। কাজেই এই সংশোধনীগুলি নোতুন শাসক শ্রেণীর পক্ষে কোন খেলার ব্যাপার ছিল না। দ্রুত বিকশিত হতে থাকা বাঙলাদেশের লুণ্ঠনজীবী লুম্পেন চরিত্র সম্পন্ন বুর্জোয়া শ্রেণী নিজেদের রচিত সংবিধানের খোলনয়চা পরিবর্তন করে তাদের নিজেদের স্বার্থের উপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছিল। এই উদ্যোগের ভেতরে চতুর্থ সংশোধনী ছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমেই সরকার তাদের ১৯৭২ সালের সংবিধানে ঘোষিত রাষ্ট্র পরিচালনার চার নীতির মূলে কুঠারাঘাতের ব্যবস্থা করেছিল। শেখ মুজিবের বাকশালী শাসন ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট উচ্ছেদ না হলে তিনি নিজেই চতুর্থ সংশোধনীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে আরও অনেক সংশোধনী এনে সংবিধানকে ফ্যাসিস্ট চরিত্র প্রদানের যে প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন তা বেশ দ্রুতই আরও এগিয়ে নিতেন।
তবে শেখ মুজিব এ কাজ সম্পন্ন করতে না পারলেও তাঁর পরবর্তী রাষ্ট্রনায়ক ও সরকার প্রধানরা তাঁর আরদ্ধ কাজ সুসম্পন্ন করেছিলেন। এদিক দিয়ে জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী, তাতে বিসমিল্লাহ রাখার ব্যবস্থাসহ অন্য সংযোজন; এরশাদের অষ্টম সংশোধনীতে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম করার ব্যবস্থা ইত্যাদিসহ সব কিছুই ছিল, যা বাঙলাদেশে নোতুনভাবে গঠিত হতে থাকা শাসক শ্রেণীর সাথে সঙ্গতি রেখেই হয়েছিল। আপাততদৃষ্টিতে যতই বিরোধী মনে হোক, পরবর্তী সংশোধনীগুলির মাধ্যমে শেখ মুজিব প্রবর্তিত সংশোধনীগুলির ধারাবাহিকতা অন্যদের শাসন আমলে প্রবর্তিত সংশোধনীগুলির মধ্যে রক্ষিত হয়েছিল। এ কারণে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল নিয়ে আওয়ামী লীগ দল ও তাদের ঘরাণার বুদ্ধিজীবীরা শোরগোল করে একে ১৯৭২ সালের আদি সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বললেও এই সংশোধনীতে ‘বিসমিল্লাহ’ রাখার যে ব্যবস্থা হয়েছিল সেটা বাদ না দিয়ে বহাল রাখা হয়েছে। অর্থাৎ পঞ্চম সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল না করে আংশিকভাবে বাতিল করা হয়েছে।
জিয়াউর রহমানকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে পঞ্চম সংশোধনীতে বিসমিল্লাহ রাখার বিষয়টিকে আওয়ামীপন্থীরা ইতিপূর্বে সব সময়ই উল্লেখ করে এসেছেন। কিন্তু এখন পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের সময় তাঁরা এই অংশ বাতিল না করে বহাল রেখেছেন। শুধু তাই নয়, আওয়ামী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে বলেছেন যে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ থাকবে কারণ এটা বাঙলাদেশের বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ!! অর্থাৎ এটা মুসলমানদের দেশ, কাজেই এখানকার ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে বিসমিল্লাহ থাকা বাস্তব কারণেই প্রয়োজন!!! আসলে এই বাস্তব কারণটি কী? অবশ্যই মুসলমান ভোটারদের ভোট প্রাপ্তির আশা। তবে এই সাথে এটা স্বীকার করতে হবে যে, ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিসমিল্লাহ না থাকাটা ছিল তৎকালীন সরকার ও সংবিধান প্রণেতাদের অবাস্তব চিন্তাধারারই পরিচায়ক। এখন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার জিয়াউর রহমানের বাস্তব বুদ্ধির সাথে ঐক্যমত পোষণ করেই সংবিধানে বিসমিল্লাহ রাখার ব্যবস্থা বহাল রেখেছে!
আওয়ামী লীগ আরও কিভাবে ধর্মের ব্যবহার করছে তার দৃষ্টান্ত আছে। তারা এরশাদের সময়কার অষ্টম সংশোধনী বাতিলের সম্ভাবনা বাতিল করেছে, যদিও এই সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে বাঙলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা করা হয়েছিল। এই রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণার সাথে বাঙলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র ঘোষণার যে কোনই পার্থক্য নেই, এটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং তাদের ঘরাণার পদলেহী বুদ্ধিজীবীরা ছাড়া অন্য কারও দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই।
সংবিধানের মুখবন্ধে বিসমিল্লাহ এবং বাঙলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম রাখা সত্ত্বেও তাদের মুখে সব সময়ই ধর্ম নিরপেক্ষতার খৈ ফুটছে। এর কারণ আওয়ামী লীগ সব সময়েই আগা এবং গোড়া দুই খাওয়ারই পক্ষপাতী। তারা ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু তাদের রাষ্ট্র ধর্ম হলো ইসলাম! জনগণের সঙ্গে এত বড় স্বচ্ছ প্রতারণার জন্য কোন বিবেক দংশন তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের তো বটেই, এমনকি তাদের ঘরাণার বুদ্ধিজীবীদেরও নেই। এই প্রতারণা করতে গিয়ে তাদের লজ্জা শরমেরও কোন বালাই নেই।
পঞ্চম সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে সদ্য নিযুক্ত প্রধান বিচারপতি বলেছেন যে, এর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঙলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রচারিত ডক্টর কামাল হোসেন!! কিন্তু কিভাবে এটা হলো?
পঞ্চম সংশোধনী শেখ মুজিবের আমলের চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করেছিল। তার আগে চতুর্থ সংশোধনীর কিছু অংশ খন্দকার মোস্তাক বাতিল করেছিলেন এ্যাক্ট বা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে। চতুর্থ সংশোধনীতে একদলীয় সরকার ইত্যাদি যে সব ধারা ছিল সেগুলি বাতিল করে পঞ্চম সংশোধনী বহুদলীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তন করেছিল। এখন পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে চতুর্থ সংশোধনী তার ফলে পুনরুজ্জীবিত হবে। চতুর্থ সংশোধনীর মত একটি সংশোধনী কার্যকর হলে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফেরৎ যাওয়া যাবে কিভাবে? কাজেই তার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন হবে শুধু জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনী নয়, শেখ মুজিবুর রহমানের চতুর্থ সংশোধনীও বাতিল করা। এই দুই কাজই করতে হবে জাতীয় সংসদে, কারণ সংবিধানের সংশোধনের সাংবিধানিক এখতেয়ার আদালতের নেই। শীর্ষ আদালত সাংবিধানিক বিষয়ের ব্যাখ্যা দিতে পারে, কিন্তু নিজে সংবিধান সংশোধন করতে পারে না। প্রধান বিচারপতি যেভাবে বলেছেন যে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১৯৭২ সালের সংবিধান তার আদিরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এটা এমন এক ভুল কথা যা দেশের প্রধান বিচারপতির অযোগ্য। শুধু তাই নয়, দায়িত্বভার গ্রহণ করার সাথে সাথে সাংবাদিক সম্মেলন তিনি জানিয়েছিলেন যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তিনি অনুরোধ করেছেন পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবিধান নোতুন করে ছাপার!
দশ
সংবিধান সংশোধন, ১৯৭২ সালের আদি সংবিধান পুনরুজ্জীবন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নিয়ে এখন সরকারী মহলে যে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে তার মূল কারণ বর্তমানে সংবিধান যে অবস্থায় আছে, তাতে এর কোন যথাযথ কার্যকারিতা নেই। সংবিধানকে একটা জগাখিঁচুড়িতে পরিণত করে দেশ জুড়ে সর্বক্ষেত্রে এক শাসন সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এই সঙ্কট থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টাতেই এখন যে সব কাজ সরকারী দলের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে সংবিধান সংশোধনীর উদ্যোগ তার অন্যতম।
কিন্তু সরকার এ চেষ্টা যেভাবেই করুক, বাঙলাদেশে শাসন সঙ্কট যেভাবে দেখা দিয়েছে তার থেকে শাসক শ্রেণীর উত্তরণ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে সম্ভব নয়। এর মূল কারণ, যে লুণ্ঠনজীবী লুম্পেন শাসক শ্রেণী এখন শাসন ক্ষমতায় রয়েছে তাদের চুরি, ঘুষ, কমিশন, ভূমিদস্যুগিরি, প্রতারণা এবং হাজার রকমের দুর্বৃত্তগিরি সমগ্র সমাজের একটা বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশের এমন অপরাধীকীকরণ করেছে যাতে সমাজের কাঠামো ভেঙে পড়ছে, শাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে এবং সমাজের ভিত্তি মূল নড়বড়ে হয়ে এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের জনগণের সামনে ১৯৭২ সালের আদি সংবিধান পুনরুজ্জীবিত করা, সেই সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি কোন আসল ইস্যু বা লক্ষ্য নয়। তাঁরা নিজেরা যে সঙ্কটের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন তার সাথে সংবিধান সংশোধনীর কোন সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ এটা নিশ্চিতভাবেই বলা দরকার যে, এই বিদ্যমান পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মৌলিক সমাজ পরিবর্তন। সেই সমাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন নোতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও নোতুন সংবিধান। কাজেই বর্তমান সংবিধান সংশোধন করে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফেরত যাওয়া নয়। এই সংবিধানকে ফেলে দিয়ে বা উচ্ছেদ করে এক নোতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন ও প্রতিষ্ঠাই বর্তমান সঙ্কট থেকে জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী সংগ্রাম সংগঠিত করাই জনগণের এই মুহূর্তের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ করণীয় কর্তব্য।
৪.১০.২০১০
[সংস্কৃতি ২০১০ অক্টোবর সংখ্যা থেকে অন্তর্জালে প্রকাশিত dorho.net থেকে সংগৃহিত ]
মুক্তির পাঠশালা
বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১১
রবিবার, ১৭ জুলাই, ২০১১
ছাত্র রাজনীতি বনাম সন্ত্রাস / শাহেরীন আরাফাত
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সোনালী ইতিহাস ছাত্রদের আন্দোলনের কাছে অসাধারন ঋনী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে স্বাধীনতার পরে ছাত্ররাজনীতির কোনো স্বচ্ছ এবং গঠনমুলক ধারা গড়ে উঠেনি আমদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ছাত্র রাজনীতির সর্বশেষ অবদান ছিল ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধি আন্দোলনে। কিন্তু এরপরই মূলতঃ পথ হারিয়ে ফেলে দেশের শীর্ষ ছাত্র সংগঠনগুলো। দলীয় রাজনীতি আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিনত হয়েছে বারবার যুদ্ধক্ষেত্রে। এর সাথে চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, ভর্তি বানিজ্য এসব তো আছেই। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সংঘর্ষে ছাত্রছাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনা সারা পৃথিবীতে বিরল হলেও বাংলাদেশে প্রায় নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালগুলোর সেশন জট নামক বিষয়টা কত অদ্ভুত আর অপরিচিত তা কেবল বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়।
এই বিষয়ে ২০০৭ সালের ছাত্র আন্দোলনকে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনাই বলতে হবে, যেখানে ছিল প্রকৃত ছাত্রদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ। যদিও তখন আমাদের তথাকথিত রাজনীতিকরা ছাত্রদের সক্রিয় আন্দোলনকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। আর তাদের হীন আচরনের জন্য এবং ছাত্রদের যোগ্য নেতৃত্ব(কারণ ছাত্রদের সংগঠনগুলো মূলতঃ রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুরবৃত্তি) না থাকায় ঐ আন্দোলন এগুতে পারেনি, বা পুরোপুরি সফল হয়নি। তবে প্রকৃত ছাত্রদের সক্রিয় ও স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ আর্মি শাসিত তত্তাবধায়ক সরকারের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল।
বর্তমানে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির তান্ডবে ফের অশান্ত হয়ে ওঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। এর উত্তাপ গিয়ে লেগেছে জাতীয় রাজনীতিতেও। ২০০৯ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে মারা যান শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি নোমানী। এর ধারাবাহিকতায় গত ৯ ফেব্রুয়ারী ২০১০ সালে একই ধরনের আরেকটি সংঘর্ষে মারা যান ছাত্রলীগ নেতা ফারুক। প্রতিদিনই চলছে কোথাও না কোথাও সংঘর্ষ অথবা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংঘর্ষের কারণেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অর্ধশতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয়। ভর্তি কার্যক্রম সঠিকভাবে চালাতে পারছেনা প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়াও চাঁদাবজি, টেন্ডারবাজি, ভর্তি বাণিজ্য, ক্ষমতার লড়াই ও হল দখলসহ অপরাধের সব শাখায়ই রয়েছে ছাত্রনেতাদের অবাধ বিচরণ। অপরাধের বৃত্তে বন্দী এখন ছাত্র রাজনীতি। স্বার্থ নিয়ে অর্ন্তকলহ আর সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে তারা। আর এর শিকার হচ্ছেন একের পর এক শিক্ষার্থী। ঘটছে জঘন্য হত্যাকান্ড। প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন এসবে জড়িয়ে পড়ছে। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ৭৩ টি হত্যাকান্ড হয়েছে। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে ঝরে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবু বকর। আবু বকরকে নিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ পর্যন্ত ছাত্রলীগের হাতে আটজন খুন হলেন। সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরের হাতে খুন হলেন ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক। বেশ কয়েকজনের রগও কেটে দিয়েছে তারা। এর রেশ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগকর্মী মাসুমও খুন হন। করিৎকর্মা পুলিশ ফারুক হত্যা মামলায় শিবিরের এক নেতাকে গুলি করেও মেলে ফেলেছে ইতিমধ্যে। এ নিয়ে এ বছরই তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির বিষাক্ত থাবায় এগারো জন ছাত্র খুন হলেন। এভাবে হত্যার মিছিলে লাশের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। এর যে রাশ টানা হবে তারও কোন লক্ষণ নেই। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো তাদের গঠনতন্ত্রে ছাত্র সংগঠনকে অংগ সংগঠন থেকে বাদ দিয়ে সহযোগী সংগঠন হিসেবে রাখলেও আগের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। ছাত্র সমাজকে লাঠি হিসেবে ব্যবহার করার প্রচন্ড আকর্ষণ থেকেই তারা ছাত্রদের দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে তাদের লেজ হিসেবে তাদের রেখে দিয়েছে। ফলে গোড়ায় গলদ রেখে সুষ্ঠু ছাত্র রাজনীতির জন্য যতই চিৎকার করা হোকনা কেন তা কোন কাজে আসবেনা।
একদিকে আবাসন সংকট, বছর বছর ফি বৃদ্ধি, প্রশাসনের হুমকি অন্যদিকে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-ছাত্রশিবিরের নির্যাতন এই হলো বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিত্র। আজ বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চিত্র একই। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, ছাত্র নির্যাতনের নিরাপত্তাহীন ফ্যাসিষ্ঠ কারাগারে বন্দী আমরা নিজেরা, আমাদের শিক্ষা জীবন। আবু বকরের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে যখন সরকারের মন্ত্রীরা বলেন, “তারা বিব্রত বোধ করছেন”, “এরকম ঘটনা ঘটতেই পারে” তখন আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না কারা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্ত্রাসীদের কাছে ইজারা দিয়েছে।
ছাত্র রাজনীতির এ নোংরা রূপটির উদ্ভব হয়েছিল ১৯৫৮ সালে পাকিস্থানে সামরিক শাসন শুরু হলে। ওইসময় দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল ছাত্রদের দমিয়ে রাখতেই তৈরী করা হয়েছিল সরকারের অনুগত ছাত্র নামের গুন্ডাবাহিনী। তবে এর আগে এ রকমের দখল পাল্টা দখলের রাজনীতি ছিলনা। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলেও ছাত্ররাজনীতিতে সংঘাত সৃষ্টি হয়নি। মুসলিম লীগের সমর্থক তৎকালীন মুসলিম ছাত্রলীগের যারা শাহ আজিজ গ্রুপ নামে পরিচিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে থাকতেন। আওয়ামীপন্থী ছাত্রলীগ তাদের কখনও উৎখাত করার চেষ্টা করেনি।
তবে সামরিক শাসন শুরু হওয়ার পরই ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে কোন্দল সংঘাত ও দ্বন্দ্ব তৈরী হয়। আইয়ুব খানের গভর্নর মোনায়েম খানের পৃষ্ঠপোষকতা ও গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্যে গঠিত হয় এনএসএফ বা ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন নামক ছাত্র সংগঠন। এদের দৌরাত্ম্য, গুন্ডামি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমেই শুরু হয় ছাত্র রাজনীতির কলংক। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পাচপাত্তু’ নামে মোনায়েম খানের অনুগ্রহভাজন এক ছাত্রনেতার উত্থান ও একসময় পতন হয়। পাচপাত্তুই ছাত্র রাজনীতিতে হত্যার রাজনীতির প্রবর্তন করে। তবে গণতন্ত্রকামী ছাত্রনেতারা তখন এ ধরনের কলুষিত রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ নেতাদের ওপর পাচপাত্তুর ভুত ভর করে। শুরু হয় হত্যার রাজনীতি।
স্বাধীনতা পরবর্তীতে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল রাত সোয়া দুইটার দিকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এমএ’র দ্বিতীয়পর্বের ছাত্র নাজমুল হক কোহিনূর, এমকম প্রথম পর্বের ছাত্র মোহাম্মদ ইদ্রিস, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রথমবর্ষের ছাত্র রেজওয়ানুল, একই বিভাগের প্রথমবর্ষের ছাত্র সৈয়দ মাসুম মাহমুদ, আবুল হোসেন, এবাদ খান এবং এমকম প্রথমপর্বের ছাত্র বশিরুদ্দিন আহম্মদ জিন্নাহকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের টিভি রুমের বাইরে সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে নৃশংসভাবে ব্রাশফায়ার হত্যা করা হয়। পরে তাদের একই হলের পানির ট্যাঙ্কে ফেলে রাখা হয়। ভোরে ট্যাপ ব্যবহার করতে গেলে পানির বদলে রক্ত বের হয়। খুনের সঙ্গে সাধারণ ছাত্রদের আতংকিত করতেই এ কাজ করেছিল খুনীরা।
ঐ নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকায় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়ায় দু’দিন পরই গ্রেপ্তার হন। একটি তদন্ত কমিটি শফিউল আলম প্রধানসহ তার সহযোগীদের অভিযুক্ত করে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়। বিচারে শফিউল আলম প্রধানসহ তার সহযোগীদের যাবজ্জীবন কারাদাণ্ড হয়। তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। পরে প্রেসিডেন্ট ক্ষমা করে দেয়ায় নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি শফিউল আলম মাত্র ১০ টাকা জরিমানা দিয়ে ছাড়া পেয়ে যান। এভাবে ছাত্রনেতারা(!) খুন করেও পার পেয়ে যান বলে ছাত্র রাজনীতিতে হত্যার রাজনীতি আর বন্ধ করা যায়নি। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ব্যালট বাক্স পর্যন্ত ছিনতাই করেছিল। পরে জিয়াউর রহমানের আমলেও ছাত্রদের মধ্যে তৈরী হয় সরকারের অনুগত বাহিনী। ছাত্রদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে জিয়াউর রহমান বিভিন্ন পন্থা নেন। জাতীয় পার্টির শাসনামলে স্বৈরাচার এরশাদও ছাত্রদের হাতে ব্যাপক আকারে অস্ত্র তুলে দিয়ে একটি অনুগত বাহিনী তৈরী করেন। স্বৈরাচার বিরোধি আন্দোলন দমন করতেই এরশাদের নির্দেশে সরকারী ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র সমাজ ছাত্রদের মিছিলে গুলি করেছিলেন। যার ফলে জীবন দিতে হয়েছিল ডা. মিলন, দেলোয়ারসহ আরও কয়েকজনকে।
১৯৯১ সালে বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই দলটির ছাত্র সংগঠন দখল করে নেয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এসময় প্রতিপক্ষ দল ছাত্রলীগের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ে তারা। এছাড়া নিজ দলের নেতাকর্মীরাও এর বিষাক্ত ছোবল থেকে রেহাই পায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের আরিফ হোসেন তাজ, সূর্যসেন হলের ক্যাডার রতন, তমিসহ আরও কয়েকজন অভ্যন্তরীণ ছাত্রদলের কোন্দলেই খুন হন। বিএনপির ২০০১ সালের ১০ই অক্টোবর বিএনপি জোট সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হয়। ১৩ই নভেম্বর জহুরুল হক হল দখল নিয়ে ছাত্রদল অস্ত্রের মহড়া দেয়। ওই ঘটনা তখন দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রথমে ১৭ই নভেম্বর সংসদে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার প্রস্তাব তোলেন। এতে বিরোধি দল আওয়ামী লীগের সাড়া না পেয়ে ১৯ই নভেম্বর তিনি ছাত্রদলের কার্যক্রম স্থগিত করেন। ২০০২ সালের ২ জুলাই ছাত্রদলের লাল্টু ও পিন্টু গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে পিন্টু গ্রুপের দুজন বহিরাগত ক্যাম্পাসেই নিহত হয়। ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামসুন্নাহার হলে ছাত্রদল নেতারা তান্ডব চালায়। তবে ছাত্ররা এর প্রতিবাদে ঝাপিয়ে পড়লেও ছাত্রদল নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এতে জোট সরকার ফের শিক্ষাঙ্গণে লাঠিয়াল বাহিনীর প্রয়োজন অনুভব করে। পরে দলের তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান ছাত্রদলকে নিজের মতো করে পুনর্গঠন করেন। কিন্তু এ দলটিও হেন সন্ত্রাসী কাজ নেই যে তাতে যুক্ত হয়নি। ২০০৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জহুরুল হক হলের ছাত্রদল নেতা খোকন নিহত হন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুল ইসলাম মামুনও গ্রুপিংয়ের ছোবলে বাচঁতে পারেননি। এছাড়াও জহুরুল হক হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহ আলমের হদিস আজ পর্যন্ত মেলেনি। জহুরুল হক হলে সভাপতি তানজীলের নেতৃত্বে মতিঝিলে তৎকালীন পুলিশের এলিট ফোর্স ‘RAB’-এর দু’সদস্যকে খুন করে। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে পাশা নামের একজন ছাত্রদল ক্যাডার অস্ত্র নিয়ে গোলাগুলি করে দেশবাসির দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়।
অপরদিকে, ইসলামী ছাত্র শিবির পুরোটাই ক্যাডারভিত্তিক ছাত্র সংগঠন। ১৯৭১ সালে জামাতের ছাত্র সংগঠন ছিলো ইসলামী ছাত্র সংঘ। কিন্তু জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার কারণে মুল দলটি নিষিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে তার ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘও নিষিদ্ধ হয়। তবে ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংঘ নাম পাল্টে রাখে ছাত্র শিবির। পরে স্বৈরাচার সরকারগুলোর আমলে শিবির তাদের ক্যাডারভিত্তিক সাংগঠনিক কার্যক্রম দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে দেয়। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় শিবির অস্ত্রভিত্তিক ছাত্র রাজনীতিতে শক্তি সঞ্চয় করে।
শিবিরের সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে এর আন্তর্জাতিক লিয়াজো। একটি আন্তর্জাতিক মুসলিম ছাত্র সংগঠন থেকে ছাত্র শিবির আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা ও আশ্রয় পায়। একেও পুরো পুরি কাজে লাগিয়েছে সংগঠনটি।
চার দলীয় জোট সরকারের আমলে তারা সরকারের অংশীদার হওয়ার কারণে এ অবস্থানকে পাকাপোক্ত করে। এসময় বিভিন্ন স্থান থেকে ছাত্রদলকেও তারা হটিয়ে দিয়ে তাদের দখল বহাল রাখে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রদল তাদের দখল সহজেই ছাত্রলীগের হাতে ছেড়ে দিলেও শিবির ছাড়েনি। ফলে ছাত্রলীগের সঙ্গে প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে যে কয়টি সংঘর্ষ হয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে শিবিরকে পাওয়া গেছে। তবে ছাত্রলীগের হামলার মুখে টিকতে না পেরে শিবির এখন আবাসিক হলগুলো ছেড়ে মেসে আশ্রয় নিয়ে অস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলেছে। গত ১৮ জানুয়ারী চট্টগ্রামের ডবলমুরিং এলাকার মিস্ত্রিপাড়ার ‘হক ভিলা’ নামের ইসলামী ছাত্রশিবিরের মেস থেকে পুলিশ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরক উদ্ধার করে। এ সময় জামায়াতের একজন সক্রিয় কর্মীসহ সংগঠনের ১২ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তিনটি রিভলবার ও তিনটি এলজি এবং চতুর্থ তলার একটি ফ্যাট থেকে একটি রিভলবার ও নাইন এমএম পিস্তলের গুলিসহ ৩৭টি গুলি, বোমা তৈরির পাউডার পাওয়া যায়।
দেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনেই ছাত্র শিবির সুকৌশলে অবস্থান করছে। শিবিরের দখলবাজিতে পড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। তারা একবার জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ও দখল করেছিল। তবে প্রশাসনের চাপে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। প্রতিটি সরকারের সময়ই সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনে প্রবেশ করে কোন্দল তৈরীর সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত রয়েছে ছাত্র শিবিরের। ফলে শিবিরেরই একটি অংশ ছাত্রলীগ ও আরেকটি অংশ ছাত্রদল কর্মী হিসেবে কাজ করে। এরা ছাত্র লীগ বা ছাত্র দল করলেও শিবিরের স্বার্থ সংরক্ষণ করে। তবে এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। অনেক সময় এরা শিবিরের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসায় শিবির কর্মী ইব্রাহিম ছাত্রলীগ করতে গিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেলে তাকে খুন করা হয়। শিবিরের এ কৌশলের কাছে দেশের প্রধান দুটি ছাত্র সংগঠনই হেরে গেছে। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোন ব্যবস্থা না নিলেও অন্তত বাস্তবতা স্বীকার করেছে। কিন্তু শিবিরের মুল দল হিসেবে জামায়াত পুরোপুরি ভিন্ন। তারা শিবিরের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কোন দিনই স্বীকার করেনি।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলেও ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক ছাত্রবাসগুলো দখলে মরিয়া হয়ে ওঠে। ১৯৯৮ সালে সূর্যসেন হল দখল করতে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতা পার্থ নিহত হন। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বাগেরহাট গ্রুপ, শরীয়তপুর-মাদারীপুর গ্রুপ এবং গোপালগঞ্জ গ্রুপ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। এদের মধ্যে সংঘর্ষ ছিল নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। ওই সময় ছাত্রলীগের ৬৭ জন বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। ২০০১ সালে ১৬ আগস্ট জিয়া হলে রিভলবারের গুলিতে ফিরোজ নামে হল শাখা ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি খুন হন।
১৯৯২ সালে ছাত্র লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অভ্যন্তরীন কোন্দলে সামসুন্নাহার হলের সামনেই খুন হন। এজন্য ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে বিচার শুরু হলেও তারা ছাড়া পেয়ে যান। ১৯৯৪ সালে ছাত্রলীগ (শা-পা) ও ছাত্রলীগ (কা-চু)-র মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের টিয়ার সেলে মাস্টার্সের ছাত্র বুলবুলও নিহত হয়েছিলেন। এবারও একই ধরনের ঘটনার শিকার হলেন আবু বকর। তবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্রলীগের দখল, লুন্ঠন, নির্যাতনের তথাকথিত রাজনীতি চরম আকার ধারণ করেছে। তাদের হাত থেকে নারীরাও রেহাই পায়নি, ক’দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মোবাইল কোম্পানির উদ্যোগে কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিল, বিকেলের দিকে সেখানে উপস্থিত আওয়ামী ক্যাডাররা দর্শক সারিতে বসা মেয়েদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে মেয়েদের উদ্ধার করা হয়, তাদের ভয়ে কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগও করার সাহস পায়নি। এর কিছু দিন আগে ২১শে ফেব্রুয়ারীতে এক ছাত্রলীগ নেতা(!) শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসা এক মেয়েকে উত্তক্ত করা শুরু করে, এক পর্যায়ে মেয়েটির শরীরে স্পর্শ করলে মেয়েটি ও তার সাথে আসা ক’জন এর বিরোধ করলে ঐ বখাটে নেতা ও তার ক্যাডার বাহিনী মেয়েটিকে ও তার সঙ্গীদের বেদম প্রহার করে। কয়েক দিন আগে ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের রেশারেশিতে বেরিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য। যার মাঝে উল্লেখ্য, দেহ ব্যবসা ও ভর্তি বাণিজ্য। ছাত্রলীগের মহিলা শাখার নেতারা হলের মেয়েদেরকে দিয়ে এমনকি বাইরে থেকে মেয়েদের এনে হলে রেখে করে যাচ্ছে রমরমা দেহ ব্যবসা, তাতে প্রকাশিত হয়েছে কিছু কেন্দ্রীয় নেতার নাম, যাদের বাড়িতেও দেহ ব্যবসার জন্য মেয়েদের সরবরাহ করা হয়। আবার ভর্তি বাণিজ্যের জন্যও ভাগ দিতে হয় কিছু কেন্দ্রীয় নেতাদের। বর্তমানে এটাই ছাত্রলীগের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, মেয়েদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ সর্বজন বিদিত। তবে এতো মাত্র শুরু, এই সরকারের মেয়াদ-কাল তো আরো বাকী প্রায় চার বছর।
একথা অবিসংবাদিত সত্য যে, জাতির সংকট ও বিপন্নতায় ছাত্রসমাজ সর্বদাই ত্রাণকর্তার ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ছাত্র রাজনীতির নামে আজ যা ঘটছে তা কোনভাবেই ছাত্র রাজনীতি নয়। তাই তাদের ঐতিহ্যময় ধারাবাহিকতা রাখতে প্রয়োজন এর মৌলিক সংস্কার। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার মধ্যে এর সমাধান নিহিত নেই। ছাত্র রাজনীতির ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা অতীতের মত ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকা উচিত এবং সে প্রেক্ষাপটে ছাত্র রাজনীতিকে অবশ্যই সুস্থ ধারার ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের স্বপক্ষে ধারার মতেঃ ছাত্র রাজনীতি মানেই সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডার বানিজ্য আর হল দখলের মত সব ন্যাক্কারজনক সব ঘটনা। গুটি কয়েক ছাত্রনেতা নামধারী সন্ত্রাসী ও তাদের অনুগামী দলের কাছে হাজার হাজার মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বনাদী হয়ে থাকার রাজনীতি নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য নয়। ধর্মঘট, নিত্যনৈমিত্যিক গন্ডগোলে ক্লাশ বন্ধ হয়ে থাকার কারণে সেশন জট তৈরী হচ্ছে, দীর্ঘায়িত হচ্ছে ছাত্রজীবন। সে কারনেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়াই মঙ্গলজনক।
একথা বলা অনাবশ্যক যে, ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল একটি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, দুটোই বুর্জোয়া শক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত। এই বুর্জোয়া ধারার রাজনীতি মানুষকে কোনো নৈতিকতা দিতে পারে না, পারে শুধু তাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে এবং ছাত্রলীগ বা বুর্জোয়া ধারার ছাত্ররাজনীতির জন্য পুরো ছাত্ররাজনীতিকে দোষারোপ করাও সঠিক নয়। তবে বুর্জোয়া রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায়ও, রাষ্ট্রের মধ্যে যদি একটি মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগে মারা যায়, সে জন্যও রাষ্ট্র দায়ী। রাষ্ট্র, সকল মানুষের দায়িত্ব নেয়ার শর্তেই তার জন্ম। সকলের সম্মিলিত সেই যুক্তিই রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখে। (যদিও বুর্জোয়া ব্যবস্থায় কথাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই লোক দেখানো; পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে মূলতঃ ব্যবহার করা হয় বিত্তহীনের আওয়াজ বন্ধের লক্ষ্যে।) কিন্তু আমরা এ কোন রাষ্ট্রে বসবাস করি? যে রাষ্ট্রে রাষ্ট্র পরিচালকগণ সাধারণ মানুষের উপর বুলডোজার চালায়, হত্যা করে, সন্ত্রাস বানায় আর রাষ্ট্রের সম্পদ (জনগণের সম্পদ) দখল করে নেয় শুধু ভোগের নিমিত্তে। অন্যদিকে এই শাসকগোষ্ঠীর কারণে সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিকরা এবং তাদের সন্তানরা মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য হয়। শুধু এখানেই শেষ নয়, তাদের সন্তানরা যখন পড়তে যায় কোনো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন তারা আবার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়। স্বাধীনতার ৩৯ বছরে শুধু শিক্ষাঙ্গনে শত শত শিক্ষার্থী সন্তানকে হারিয়েছে শত শত মাতা-পিতা ও বাংলাদেশ।
ছাত্র রাজনীতির অর্থ যদি সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার আদায়ের রাজনীতি হয়, সৃজনশীলতা বিকাশের পথ হয়, তবে সেক্ষেত্রে ছাত্র রাজনীতি কোন ভাবেই অকাম্য হতে পারেনা। যেসব বিষয় ও সমস্যা ছাত্রজীবনে অহর্নিশি মোকাবেলা করতে হয় যেমনঃ শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, শিক্ষার মান ও পাঠক্রমের সময়পযোগী পরিমার্জন, আবাসিক সমস্যা, হলে খাবারের মান, লাইব্রেরী সমস্যা, খন্ডকালীন কর্মসংস্থান ইত্যাদিকে ঘিরে অধিকার চর্চা বা পথ নির্দেশনা কোনভাবেই দূষনীয় নয়।
আবার জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতির প্রতি প্রকৃতির ভাঙ্গাগড়ার মধ্যে প্রত্যক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে অর্থবহ অবদান রাখার নিমিত্তে ছাত্র সমাজ সমকালীন রাজনীতিকে চিন্তার খোরাক কিংবা আদর্শের পথ বাতলে দেবে এবং তাতে জাতীয় রাজনীতি সমৃদ্ধ হবে। এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, সার্বক্ষণিক রাজনীতি ছাত্রদের জন্য নয়। প্রাথমিক কর্তব্যে জ্ঞানার্জন বা ভাল ডিগ্রী নিয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া। লেজুড়বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি নয়, অর্থাৎ কোন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন বা অংশ সংগঠন না হয়ে ছাত্র রাজনীতিকে সক্রিয় হতে হবে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার আলোকে। মূল ধারার আনুগত্য নয় বরং নিজস্বতা থাকতে হবে। নগন্য সংখ্যক ছাত্র রাজনৈতিক দলের ধামাধরা হয়ে ছাত্র রাজনীতির দর্শন ও পথকে দুর্দশাগ্রস্থ ও সংঘাতময় করে তুলবে তা যে কোন দৃষ্টিতেই অনভিপ্রেত।
ছাত্রদের নৈতিক স্খলনের জন্য শিক্ষকরা তাদের দ্বায় এড়িয়ে যেতে পারেন না, এক্ষেত্রে যেখানে তাদের এগিয়ে আসার কথা, সেখানে শিক্ষকদের একটি অংশ তাদের নিজ স্বার্থের জন্য শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছে দলীয় ক্যাডার হিসেবে। এসম্পর্কে মাত্র কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের বিভাগীয় সভাপতি আব্দুল্লাহ হেল কাফী কর্তৃক ঐ বিভাগেরই এক মহিলা প্রভাষককে যৌন হয়রানীর অভিযোগটি অগ্রগণ্য। কাফী ব্তমান ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় লালিত, আর এর প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার পক্ষে নগ্ন ভূমিকা পালন করছে। (আজও কর্তৃপক্ষ "প্রথম আলো" দৈনিকে তাদের বিবৃতি ছেপেছে) জনাব কাফী ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সরকার দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টায় রতঃ, এই ঘটনার পর তিনি তিনি ছাত্র লীগ ক্যাডারদের দিয়ে ইতিমধ্যে দুই বার মারামারির ঘটনা ঘটিয়েছেন। তবে তিনি একা নন, এমন আরো বেশ কিছু শিক্ষক নামধারী দলীয় চাটুকার রয়েছে, যারা দলীয় ও নিজ স্বার্থে ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাসের বীজ ছড়িয়ে চলেছে, তাদের রুখতে হবে আগামীর সম্ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখতে।
এখন সময় এসছে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ছাত্র রাজনীতিকে অনুধাবন করার এবং যৌক্তিকতার মাপকাঠিতে সবচাইতে শ্রেয় বিষয়গুলির আদলে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সার্বিক সিদ্ধান্তও গ্রহণ করতে হবে।
ছাত্র রাজনীতির দিক নির্দেশনা নিয়ে অনেক ভাবনাই রয়েছে তার কিছু উপস্থাপন করছিঃ
(১) ছাত্রসংগঠন সমুহের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে তথাকথিত লেজুড়বৃত্তি সুলভ যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে। তাদের রাজনৈতিক দলগুলির দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের অশুভ প্রয়াস রুখতে হবে।
(২) রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সমাজের বিবিধ সমস্যা সমাধানে সততা এবং স্বচ্ছতা প্রয়োজন।
(৩) ছাত্র সংগঠনে কেবল মাত্র ছাত্রদের অংশগ্রহণই নিশ্চিত করতে হবে।
(৪) ছাত্র সংগঠনের গতি-প্রকৃতিকে বিশুদ্ধ করতে শিক্ষকদের অগ্রনী ভুমিকা পালন করতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের জবাবদিহিতা ও দ্বায়বদ্ধতার ব্যবস্থা হতে পারে অন্যতম সহায়ক শক্তি। নতুবা কাফীদের দখলেই থেকে যাবে শিক্ষাঙ্গন।
(৫) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যবস্থাপনাগত দিকে উন্নয়নের যথেষ্ঠ অবকাশ রয়েছে। যাতে, শিক্ষক, বিশেষ ব্যক্তিত্বসমূহ, সর্বোপরি সরকার এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
(৬) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতীর ভিত্তিতে কেবলমাত্র মেধাবী এবং সৎ ছাত্রগণই ছাত্র সংগঠনে নেতৃত্বের পদ অলংকৃত করতে পারে।
চটজলদি ছাত্র সংগঠনের সম্পূর্ণ শুদ্ধিকরণ হয়ত অসম্ভব। কিন্তু এ ব্যাপারে বিভিন্ন পর্যায়ে করণীয় অনেক কিছুই আছে। এছাড়া স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সুশীল সমাজের চিন্তাভাবনা ও দিক নির্দেশনা ছাত্র সংগঠনকে যথাযথভাবেই পরিশীলিত ও গ্রহণযোগ্য করতে পারে।
আমরা ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে নই বরং ছাত্ররাজনীতিকে যে কোন মূল্যে তার অশুভ বলয়, অনৈতিক ধারা থেকে ফিরিয়ে আনতে চাই। আমরা চাই, ছাত্র রাজনীতি নিয়ে চলমান রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন হোক। যদি এমনটি প্রয়োজন পড়ে যে, সার্বিক কল্যানে ছাত্র রাজনীতি নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হবে, তবে তাও ভেবে দেখা হোক। সন্ত্রাসীর পরিচয় হোক সন্ত্রাসী হিসেবে আর ছাত্রের পরিচয় ছাত্র হিসেবেই; কোন ভাবেই একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নয়। ছাত্র রাজনীতির এই সংকট মোকাবেলার সামর্থের উপর আমাদের ভবিষ্যত পথ চলা অনেকাংশেই নির্ভর করছে।
সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, উদ্যোগ ও আন্তরিকতায় ছাত্র রাজনীতির বর্তমান বিবর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটুক এই কামনা করছি।।
টেলিযোগাযোগ শিল্পে বিদেশী কোম্পানিগুলোর আগ্রাসন ও হাড় ভাঙ্গা বিটিআরসি / শাহেরীন আরাফাত
মোবাইল এখন আমাদের যোগাযোগের অন্যতম হাতিয়ার স্বরূপ। কিন্তু এ শিল্প সম্পর্কিত কিছু কথা না বলে পারছি না। আপনি কি মনে করেন, গ্রামীণ ফোন, বাংলালিংক, একটেল, ওয়ারিদ; এই বিদেশী মোবাইল কোম্পানিগুলো আমাদের অর্থনীতির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করছে? এদের কল্যানে আমরা প্রতিদিন কত টাকা হারাচ্ছি তা জানেন?
এরা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগীতায় যেতে চায় না। আপনি মনে করেন, টেলিটক যদি পুরোদমে মাঠে নামতো- এরা কেউ কি টিকতে পারতো?? যে অপারেটর কোম্পানীগুলো এখানে ব্যবসা করছে, তাদের সরাসরি আয়ের উৎস এদেশের মানুষ। তারা প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, কিন্তু সেটা খরচ হচ্ছে কোথায়? ঐ টাকার কতটুকু এদেশে থাকছে?
ভেন্ডর কোম্পানী গুলো তাদের ইকুয়েপমেন্ট বিক্রি করছে; এর দাম কত? গ্রামীন ব্যবহার করে এরিকসন, বাংলালিংক সিমেন্স, এরিকসন ও হুওয়ায়েই ইকুয়েপমেন্ট। নেটওয়ার্ক তৈরিতে যে ইকুয়েপমেন্ট লাগে সেগুলো হচ্ছে বিটিএস, বিএসসি, এমএসসি, এইচএলআর, আইএন প্রভৃতি। প্রতিটির দাম আকাশচুম্বি। একটু উদাহরণ দেই, সিমেন্স এর একটা বিটিএস এর দাম ৫০ লক্ষ টাকা, এরকম বিটিএস বাংলালিংক কিনছে মাত্র দুটো বিভাগের(ঢাকা ও খুলনা) জন্য মোট প্রায় ১৭০০ টা। সারা দেশে তাহলে তাদের কটা বিটিএস আছে, চিন্তা করুন? আর গ্রামীন ফোন, তাহলে সারা দেশে তার নেটওয়ার্ক বিস্তার করতে কতটা বিটিএস বসিয়েছে, একবার ভাবুন। এর বাইরে অন্য ইকুয়েপমেন্ট তো আছেই। ট্রান্সমিশনও প্রতি বিটিএস সাইটে, বিএসসি সাইটে করতে হয়। বিটিএস এর চেয়ে বিএসসির দাম বেশি, তার চেয়ে এমএসসির। এর বাইরে আছে সফটওয়্যারের দাম। একটা উদাহরণ দেই, আইএন এর একটা সফটওয়্যার আপগ্রেডেশনের জন্য ভেন্ডর কোম্পানি একটি আইএন এর চেয়ে বেশি দাম(কয়েক লাখ ইউরো) নেয়। এবার সর্বমোট বিনিয়োগটা অনুমান করতে পারছেন?
এখন কথা হচ্ছে, এই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ওরা এখানে খাটিয়েছে কেন? কারণ, তারা খাটিয়েছে এটা জেনে যে, সে মুনাফা করতে পারবে; নিশ্চয় আমরা দূরদূরান্তে বসে আরামে মোবাইলে কথা বলতে পারবো, সেজন্য না এবং এটুকু জেনে রাখুন, এই কলের মাধ্যমেই গ্রামীন ফোন ইতিমধ্যেই তার প্রায় পুরা বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে। তারমানে, এই ক'বছরে আমাদের দেশের মানুষের পকেট থেকে কত বিলিয়ন টাকা তারা হাতিয়ে নিয়েছে হিসাব করুন!!!
আর, বাংলালিংক যদি লসেও থাকে, তাতে আমাদের কি কোন লাভ হয়েছে? তারাও কিন্তু এই মানুষের পকেট থেকেই তো টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে! কেনাবেচার যে কথা হচ্ছে, সেটা বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির একটা অতি সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনা। বাংলালিংক এই দৌড়ে টিকতে না পারলে হয়তো বিক্রি করে দিবে কোম্পানি, যেমনটা ক’দিন আগে করেছে ওয়ারিদ এবং এর মাধ্যমে তার বিনিয়োগকৃত টাকা তুলেই নিয়ে যাবে, সে টাকা তো আর এদেশে থাকছে না! আর গ্রামীন যেহেতু লিডিং, তারা মনোপলির দিকে যাবে। এগুলো সবই ব্যবসা। আর আমরা হচ্ছি সেই ব্যবসার মূল সোর্স মানে মূল অর্থ যোগান দাতা। এবার ভারতকে দেয়া হচ্ছে টেলিকরিডোর। ভারতী এয়ারটেল ও রিলায়েন্স কমিউনিকেশন্স যৌথভাবে বিটিআরসির কাছে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের টেলিকরিডোর স্থাপন করার অনুমতি চাওয়ায় সরকার এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। তবে এ বিষয়ে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে।
এয়ারটেল সম্প্রতি বাংলাদেশের ওয়ারিদের ৭০ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছে। এই শেয়ার কেনার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এয়ারটেল গত বছরের শেষ দিকে টেলিকরিডোর দেয়ার আবেদন করে। জানা গেছে, এ করিডোর দিয়ে তারা ফাইবার অপটিক ক্যাবল স্থাপন করে উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭ রাজ্যের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ সহজ ও সস্তা করতে চায়। তারা আসামে টেলিকরিডোরের জন্য দুটি রুটের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো কলকাতা-মেহেরপুর-ঢাকা-জাফলং এবং অন্যটি কলকাতা-মেহেরপুর-ঢাকা-কুমিল্লা-আগরতলা রুট। বর্তমানে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো ভিস্যাটের মাধ্যমে ভারতের কেন্দ্র ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত, যা খুবই ব্যয়বহুল।
বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই করিডোর নেয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতে টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট ইত্যাদি সস্তা হবে ও বিনিময়ে বাংলাদেশ কিছু চার্জ বা ভাড়া পাবে। কিন্তু এর মাধ্যমে আবার উত্তর-পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামীদের কথোপকথন মনিটরিং থেকে শুরু করে ফাইবার অপটিক কেবলের টেলিকরিডোরের নিরাপত্তার নামে বাংলাদেশের ওপর ভারতের সামরিক ও টেকনোলজিক্যাল নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হবে। অন্যদিকে দেশের যোগাযোগ খাতের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ খর্ব হবে এবং তা বিপজ্জনকভাবে প্রতিবেশীর হাতে চলে যাবে।
ভারতী এয়ারটেল ভারতের সর্ববৃহত্ টেলিকম কোম্পানি। এর গ্রাহকসংখ্যা ১১ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি। কোম্পানিটি সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের বাজারে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। ফলে মুনাফা বাড়াতে দেশের বাইরে বিনিয়োগ করার উদ্যোগ নেয়। দক্ষিণ আফ্রিকার এমটিএন মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের মার্জার বা একীভূত হওয়ার প্রস্তাবনা ব্যর্থ হওয়ার পর ওয়ারিদের ৭০ শতাংশ শেয়ার কিনে কার্যত বাংলাদেশে একটি মোবাইল কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। প্রশ্ন উঠেছে, ১৫ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে এরই মধ্যে গ্রামীণফোনের গ্রাহকসংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখ, বাংলালিংকের গ্রাহকসংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ, একটেলের গ্রাহকসংখ্যা ৮৮ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়ার পরও কেন কোম্পানিটি বাংলাদেশের বাজারে বিনিয়োগ করতে এলো?
এর পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের মোবাইল কোম্পানিগুলোর গ্রাহকসংখ্যা অনেক হলেও এর ঘনত্ব বা টেলিডেনসিটি ভারতের তুলনায় এখনও অনেক কম। ভারতের টেলিডেনসিটি যেখানে শতকরা ৪৬ ভাগ, বাংলাদেশে সেখানে মাত্র ৩২ ভাগ। ফলে এয়ারটেলের পক্ষে সুযোগ রয়েছে এর গ্রাহকসংখ্যা আরও বাড়ানোর। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ফাইবার অপটিক কেবল ভারতের কেন্দ্র থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে নিয়ে যাওয়া এবং সেখানকার বিশাল বাজার ধরা।
ওয়ারিদ সূত্র থেকে জানা যায়, ভারতী এয়ারটেল এরই মধ্যে বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী পাঠিয়েছে। তারা কাজে যোগও দিয়েছে। ওয়ারিদের শেয়ার কেনার ক্ষেত্রেও এয়ারটেল কৌশলের আশ্রয় নেয়। ওয়ারিদের মোট মূল্য ১ কোটি টাকা দেখিয়ে মাত্র ৭০ লাখ টাকা বা ১ লাখ ডলারের বিনিময়ে ওয়ারিদ টেলিকমের ৭০ ভাগ শেয়ার কিনে নেয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয়, ওয়ারিদ একটি লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে, ফলে টোকেনমূল্য দিয়ে ওয়ারিদকে এয়ারটেল কিনে নিচ্ছে। পরে এয়ারটেল ওয়ারিদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য আরও ৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে বলে বিটিআরসিকে জানিয়েছে।
কিন্তু ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ওয়ারিদের মালিক ধাবি গ্রুপের স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুসারে ওয়ারিদের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে ধাবি গ্রুপের ৭৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার কথা। প্রশ্ন উঠেছে এই ৭৫ কোটি ডলার গেল কোথায়? ওয়ারিদ কি এতই দেনাগ্রস্ত যে এর দাম এখন মাত্র ১ লাখ ডলার? অথচ নেটওয়ার্কের কাজে ওয়ারিদ এরিকসন বা মটোরোলার কাছ থেকে যেসব যন্ত্রপাতি কিনেছে সেগুলোর দাম হিসাব করলেও তো ৫০ থেকে ৬০ কোটি ডলারের কম হবে না! ওয়ারিদের ব্যবহৃত প্রায় তিন হাজার বিটিএসের এক একটির দামই ৫০ হাজার ডলার, সেই বিটিএসগুলোর কন্ট্রোলার হিসেবে ব্যবহৃত মোট ২৫টি বিএসসি’র এক-একটির দাম কমপক্ষে আড়াই লাখ ডলার, এর সঙ্গে যুক্ত হবে এমএসসি, আইএন, ভাস, ট্রান্সমিশন ইকুইপমেন্ট ইত্যাদির মতো আরও মূল্যবান যন্ত্রপাতির দাম। সঙ্গে রয়েছে ব্র্যান্ড ভ্যালু, লাইসেন্স ফি ইত্যাদির হিসাবও। এ বিষয়ে ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিষয়ক ওয়েবসাইট ভিসি সার্কেল একটি হিসাব প্রকাশ করে যেখানে বলা হয়, ‘ওয়ারিদের সম্পদের মূল্যায়ন করে বলা যায় এর পরিমাণ ৫০ থেকে ৫৫ কোটি ইউএস ডলার হবে, ফলে ভারতী এয়ারটেলকে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি ডলারে ওয়ারিদের ৭০ ভাগ শেয়ার কিনতে হতে পারে।’
তাহলে এই ১ লাখ ডলার বা ৭০ লাখ টাকার মতো কম দাম দেখানোর রহস্য কী? এর আসল বিষয় হলো বিটিআরসি’র একটি নিয়ম—বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১-এর ধারা ৩৭(১) অনুসারে বিটিআরসি থেকে লাইসেন্স পাওয়া কোনো কোম্পানি অন্য কোনো কোম্পানিকে লাইসেন্স বিক্রি করতে পারবে না। কিন্তু ৩৭(৩)-এর ঝ উপধারা অনুসারে শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবে। আর এই শেয়ার হস্তান্তরের সময় শেয়ারের মূল্যের ৫.৫ ভাগ বিটিআরসিকে দিতে হবে। এখন ওয়ারিদের ৭০ ভাগ শেয়ারের মূল্য ৩০ কোটি ডলার দেখালে এর ৫.৫ ভাগ অর্থাৎ ১ কোটি ৬৫ লাখ ডলার বা ১১৫.৫ কোটি টাকা বিটিআরসিকে দিতে হতো। কিন্তু শেয়ারের মূল্য নামমাত্র ৭০ লাখ টাকা দেখানোর কারণে এখন বিটিআরসিকে দিতে হবে ৭০ লাখ টাকার ৫.৫ ভাগ অর্থাৎ মাত্র ৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।
মূল বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করার চেস্টা করছিঃ
এখানে দু'ধরণের কোম্পানী আছে- অপারেটর(জিপি, বিলিংক, একটেল, ওয়ারিদ, সিটিসেল ইত্যাদি) ও ভেন্ডর(সিমেন্স, এরিকসন, হুওয়ায়েই ইত্যাদি)। অপারেটর একটি দেশী ও বাকিগুলো প্রধানত বিদেশী। দেশী, বিদেশী সব অপারেটরই ইকুয়েপমেন্টের জন্য বিদেশী কোম্পানীর উপর নির্ভরশীল। এই ব্যবসার মূল লক্ষ্য ও উৎস অর্থের যোগানদাতা গ্রাহক(আমাদের দেশের জনগণ)। শুরুতে প্রতিটি অপারেটর প্রচুর বিনিয়োগ করে তার বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পাবার সম্ভাবনা ও মুনাফার সম্ভাবনা পরিমাপ করেই, কারণ তারা এখানে ব্যাবসা করতে এসেছে- কোন দাতব্যালয় খুলতে নয়। সেই তুলনায় ভেন্ডরের বিনিয়োগ কম বা নেই বললেই চলে। (হুওয়ায়েই এর অবশ্য প্রাথমিক বিনিয়োগ বেশী)। ইকুয়েপমেন্ট বিক্রির পুরো টাকাটা তাদের পকেটে। অপারেটর তার বিনিয়োগের বড় অংশ বলতে গেলে সিংহভাগ খরচ করে ইকুয়েপমেন্ট কিনতে। সেটা চলে যায় বিদেশী ভেন্ডর কোম্পানীতে।
বড় মাপের কোম্পানীতে লাভ-লোকসানের হিসাব একটু অন্যরকম। এমন অনেক ইনভেস্ট তারা করে, যার মুনাফা হয়তো তাদের হাতে আসবে ১০/১৫ বছর পরে বা তারও আরো পরে। তাদের ইনকাম ফোরকাস্টিং এর একটা বিষয় থাকে। গ্রামীনফোনও কিন্তু বিগত বছরগুলোতে বিনিয়োগের অনেক পিছনে পিছনে দৌঁড়িয়েছে। তারপর বর্তমানে এসে বিনিয়োগকৃত টাকা তুলে ফেলেছে। এই বছরগুলোতে তাদের অবস্থানকে অর্থনীতির ভাষায় লস বলা হয় না। তেমনি, বাংলালিংকের বর্তমান অবস্থাকেও লস বলা যায় না। বাংলালিংকের সমস্যা হচ্ছে, বর্তমান প্রতিযোগিতায় তারা পুঁজির দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে।
এই কোম্পানী গুলো যে টাকা খাটাচ্ছে, তা কিন্তু এ দেশে কোন উৎপাদন খাতে নয়, এটাকে বলে সেবা খাত। সেবা খাত দেশের উৎপাদনে ভূমিকা রাখে পরোক্ষ ভাবে। তাদের বিনিয়োগের অংকটা অনেক বিশাল, কিন্তু সেটা এদেশে কোন সরাসরি কাজে লাগছে না, কিছু কর্মসংস্থান ছাড়া। সিংহভাগই চলে যাচ্ছে, ভেন্ডর কোম্পানীর হাত ধরে বিদেশেই। আমরা টেলি সেবা কিনছি চড়া মুল্যে। চড়া মূল্য নির্ধারিত হয়, ২৫ পয়সা/ মিনিট কথা বলা দিয়ে না, এদেশ থেকে কত অর্থ আমরা হারাচ্ছি- তা দিয়ে। আনুমানিক একটা হিসাব দিয়েছি। হিসাবটা কিছু প্রাপ্ত উপাত্তের উপর ভিত্তি করে, কিন্তু প্রকৃত চিত্র মতে হয়তো আমরা আরো বেশী অর্থ হারাচ্ছি। গ্রামীনের বিনিয়োগ দেখুন আর হিসাব করুন বছর দিয়ে ভাগ দিয়ে। তাহলে বুঝতে পারবেন, কত টাকা চলে যাচ্ছে।
একটা দেশের জিডিপি গণনা করা হয়, তার উৎপাদন ও তার আয় দিয়ে, অবশ্যই তা থেকে খরচ বাদ দিয়ে। হিসাব করুন এই বিনিয়োগ আমাদের জিডিপিতে কি প্রভাব রাখছে? ঋণাত্মক প্রভাব। এখানে এই সেবার পরোক্ষ ভূমিকাও গৌন। কেননা, সেবাখাতের পরোক্ষ ভূমিকা উল্লেখযোগ্য তখনই হয় যখন সেদেশ উৎপাদনের সাথে জড়িত থাকে ও ঐ সেবাটি উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। আমাদের বাংলাদেশে শিল্প কোথায়?
দেখা গেছে, টোটাল টক আওয়ারের ৮০%, আনঅফিসিয়াল/ননবিজনেস কল। প্রকৃতপক্ষে এই হার আরো বেশী হবে, কেননা অফিসিয়াল/বিজনেস কলগুলোরও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আনঅফিসিয়াল/ননবিজনেস।
হুওয়ায়েই এর প্রাথমিক বিনিয়োগের কথা এ প্রসঙ্গে বলি। তাদের অফারটা হচ্ছে অনেকটা এরকম, আমাদের ইকুয়েপমেন্ট দিচ্ছি, সেট করেও দিচ্ছি, এখন কোন টাকা লাগবে না, ইকুয়েপমেন্ট লাগানো মানেই কল, আর কল মানেই টাকা, তারপর তোমরা সেই টাকা থেকে আমার ইকুয়েপমেন্টের টাকাসহ(দুবছর পর) সার্ভিস চার্জ দিয়ে দিও (একটেলের সাথে এগ্রিমেন্ট দ্রষ্টব্য)। এরা এত নিশ্চিত যে, মাগনাতেও ইকুয়েপমেন্ট বেচতে দ্বিধা বোধ করে না। এই নিশ্চিন্ত হবার সোর্স কিন্তু ঐ একটাই - কল, মানে আমাদের কষ্টার্জিত টাকা।।
টেলিকমিউনিকেশনে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এত উতলা হয়ে কেন এখানে বিনিয়োগ করেছে? একটাই কারণ, এই সেক্টর থেকে মুনাফার দারুণ ও নিশ্চিন্ত সুযোগ। প্রশ্ন আসতে পারে গ্রামীণ ফোন ইতিমধ্যে ৩০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে- আমরা কি পারবো একটা খাতে এত টাকা বিনিয়োগ করতে? গ্রামীণ ফোন তার প্রাথমিক পুঁজি বছর খানিক আগেই তুলে নিয়েছে। আর সেটা এখানকার জনগণের পকেট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়েই। ফলে চিন্তা করুন- আপনি যে ৩০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা ভাবছেন, সেই টাকার চেয়েও বেশী টাকা ইতিমধ্যে আমাদের দেশের মানুষের পকেট থেকে খোয়া গেছে! কয়েক বছর থেকেই- গ্রামীণ তার টার্ণ ওভারের একটা বড় অংশ এখানে বিনিয়োগ করছে। অর্থাৎ, এই বিনিয়োগ তারা বাইরে থেকে আনছে না। এটা এ দেশের মানুষের পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়ে এখানেই বিনিয়োগ করছে- উদ্দেশ্য আরো বেশী টাকা হাতিয়ে নেয়া। বাংলালিংকও এতদিনে তার প্রাথমিক পুঁজি তুলে ফেলতে পারতো (বর্তমানে সে মার্জিনের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে); কিন্তু প্রতিযোগিতায় খুব ভালোভাবে থাকার উদ্দেশে সে তার টার্ণ ওভারের পুরোটাই এখন পর্যন্ত রিইনভেস্ট করছে- যার উদ্দেশ্য আরো বেশী টার্ণ ওভার। বেশী বিনিয়োগ করা মানে বেশী টার্ণ ওভার। মানে- বেশী সুইচ, বিটিএস, বিএসসি, টিআরএক্স; মানে বেশী কল ক্যাপাসিটি, বেশী গ্রাহক, বেশী কল, বেশী টাকা। গ্রামীণ ফোনের বাৎসরিক অপারেটিং প্রোফিট (খরচাপাতি বাদে) ৮০০ মিলিয়ন ইউএসডি, আর বাংলালিংক ও একটেলের প্রত্যেকের প্রায় ২০০ মিলিয়ন ইউএসডি। ৬/৭ বছর আগে (৭টাকা/মিনিটের যুগে) গ্রামীণ ফোনের মাসিক অপারেটিং প্রোফিটই ছিল প্রায় ২০০ মিলিয়ন ইউএসডি (ভিতরে ভিতরে যে আরো অনেক বেশী আয় এদের ছিল এবং এখনো আছে- ভিওআইপির ট্যাক্স ফাঁকির মত- সেটা সাম্প্রতিক ঘটনায় স্পষ্ট)।
গত বছরের নভেম্বর মাসের রিপোর্ট মতে, দেশের মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর মোট গ্রাহক সংখ্যা আবারও কমেছে। গত অক্টোবর মাসের তুলনায় নভেম্বরে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলোর গ্রাহক কমেছে ৮ লাখ ৫০ হাজার। ঐ এক মাসে সার্বিকভাবে মোবাইল ফোনের গ্রাহক কমলেও তিনটি অপারেটরের গ্রাহক সংখ্যা আবার বেড়েছে। কমেছে অন্য তিনটি অপারেটরের গ্রাহক। গত অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে ছয় অপারেটরের মধ্যে একটেল, সিটিসেল এবং টেলিটকের গ্রাহক কমেছে। এর মাধ্যমে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে কোটি গ্রাহকের মর্যাদাও হারিয়েছে একটেল। অন্যদিকে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক এবং ওয়ারিদের গ্রাহক উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, অক্টোবর মাসের শেষে দেশে মোট মোবাইল গ্রাহক ছিল ৫ কোটি ১৪ লাখ। নভেম্বরের শেষে সেটি দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৫ লাখ ৫০ হাজারে। এ সময় শুধু একটেলের গ্রাহক কমেছে ২১ লাখ ২০ হাজার। এতে করে তাদের গ্রাহক সংখ্যা কোটির নিচে নেমে এসেছে। গত অক্টোবর মাসে একটেলের গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার। নভেম্বরের শেষে সেটি দাঁড়ায় ৮৮ লাখ ৭০ হাজারে। সিটিসেল ১৯ লাখ ৮০ হাজার থেকে ১০ হাজার কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৭০ হাজারে। একমাত্র রাষ্ট্রীয় মোবাইল অপারেটর কোম্পানি টেলিটকেরও গ্রাহক ১০ হাজার কমে ১০ লাখ ৬০ হাজার হয়েছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও, এক মাসে ২১ লাখের বেশি গ্রাহক কমে গেলেও এতে খুব বেশি চিন্তিত নয় একটেল। তাই প্রশ্ন জাগতে পারে কেন তারা চিন্তিত নন? এর কারণ হলো, তারা খুব ভাল করেই জানেন যে বর্তমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় তাদের এ নেতিবাচক প্রভাবও কেবলই সাময়িক, তাতে তাদের বিনিয়োগ উত্তরনে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না।
এবারে আসি টেলিটকের ব্যাপারে......
টেলিটক বাংলাদেশ লিঃ (কোম্পানী) কোম্পানী এক্ট, ১৯৯৪ এর অধীনে ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরে ২০,০০০,০০০,০০০ টাকা মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এটিই দেশের একমাত্র সরকারী অর্থায়নে পরিচালিত মোবাইল কোম্পানী। এর বর্তমান চেয়ারম্যান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব সুনীল কান্তি বোস। তাছাড়া পরিচালক পর্ষদ গঠিত ১০ জন সদস্য নিয়ে যারা বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার।
টেলিটক/বিটিটিবি মোবাইল মার্কেটে আসার আগেই এর খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি সুবিধা ছিলঃ
ক) ইতিমধ্যে তৈরী একটা ক্ষেত্র- টেলিটক সিম বাজারে আসার ঘোষণার আগে থেকে সিম কেনার লম্বা লাইন দ্রষ্টব্য, যেটা অন্যান্য অপারেটরদের অর্জন করতে বেশ কিছু বছর পার করে দিতে হয়েছিল।
খ) বিটিটিবির ইতিমধ্যে তৈরী একটা অবকাঠামো- যা তার প্রাথমিক বিনিয়োগকে অর্ধকের বেশী কমাতে সক্ষম।
বাংলাদেশের মার্কেট পোটেনশিয়াল উপরের আলোচনায় যদি বুঝতে পারেন, তবে এটাও বোঝার কথা যে, কলের টাকা থেকেই রিইনভেস্টমেন্টের মাধ্যমে এই খাতে টেলিটক/বিটিসিএল আগাতে পারতো। একটেল, গ্রামীণ ফোন, বাংলা লিংক এরা যেসব ভেণ্ডর থেকে ইকুয়েপমেন্ট নেয় তার বড় অংশই নেয় বাকিতে হুওয়ায়েই এর সাথে একটেলের চুক্তি বা, গ্রামীণ ফোনের সাথে হুওয়াইয়ের চুক্তি দ্রষ্টব্য)। ফলে প্রাথমিক বিনিয়োগ এখন আরো কম, কেননা এর মাধ্যমে ব্যবসা করার পর মুনাফা থেকে ইকুয়েপমেন্টের মূল্য পরিশোধ করার সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। টেলিটক এ ধরণের কন্ট্রাক্টে গেলে, তার জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ তাহলে কতখানি দরকার? এখনো এই ঢিলেতালে চলার মধ্যেও টেলিটক কিন্তু প্রতিবছর ভালোই আয় করছে।
এখন হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে টেলিটক নিয়ে যে, যেখানে এই মোবাইল কোম্পানী গুলো এত কমে কলরেট অফার করছে, সেখানে তারা এত অবকাঠামোগত সুবিধা নিয়েও কেন এর কম কলরেট রাখতে পারে না, এখনো কেন ভাল নেটওয়ার্ক সিস্টেমও গড়ে তুলতে পারেনি?
সরকার থেকে বাড়তি বিনিয়োগ নয়, তার বাৎসরিক লভ্যাংশকে পুনঃবিনিয়োগই কর্তৃপক্ষ ঠিক ভাবে করে না। যতখানি নেটওয়ার্ক তারা গড়ে তুলেছে, সেটিকেও ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না, এতদিনেও নিজস্ব এক্সপার্টিজ গড়ে তোলেনি। উপরন্তু, বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে লসের পরিমাণ বাড়িয়েছে। তার মধ্যে একটি উদাহরণ দেইঃ সিমেন্স বাংলালিংকে যে দামে ইকুয়েপমেন্ট বিক্রি করে- একই ইকুয়েপমেন্ট তার কয়েকগুণ বেশী দামে টেলিটকের কাছে বিক্রি করে।
আসুন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজি,
কেন টেলিটক পূর্ণ উদ্যমে চালানো হয় না? কেন টেলিটক সিম বাজারে আসতে এত সময় নেয়া হল? গ্রামীণ ফোন ও বাংলালিংক মার্কেটে একটা স্ট্যাবলিশড অবস্থায় যাবার পরেই কেন টেলিটক বাজারে আসবে? এসবে কাদের লাভ হয়েছে বা এখনো হচ্ছে? সিটিসেল/জিপি যে সময় মার্কেটে এসেছিল- সে সময় থেকেই যদি তৎকালীন বিটিটিবি (বর্তমান বিটিসিএল) টেলিটক মাঠে নামাতো? বিটিসিএল-এর প্রস্তুত অবকাঠামোতে খুব অল্প খরচে নেটওয়ার্ক স্ট্যাবলিশ করতে গ্রামীন ফোন বা বাংলালিংক এর তুলনায় অনেক কম সময় কি লাগতো না? (যেখানে জিপি বিটিসিএল-এর রেলওয়ের ব্যাকবোন নামমাত্র মূল্যে লীজ নিয়ে সেখান থেকে বেআইনি ভাবে সাবলিজ দিয়ে ব্যবসা করতে পারে!) গুড উইল ধরে রাখার জন্য সামান্য চেস্টা করা কি যেত না?
সিস্টেম মানুষই তৈরী করে, মানুষই ভাঙ্গে। প্রতিটা নতুন সিস্টেম গড়ে উঠে পুরাতন সিস্টেমের অসংগতিগুলো শুধরে নিতে, যা হবে মানুষের কল্যাণকামী। কিন্তু এটাও ঠিক যে একটা সিস্টেম গড়ে তোলার পরে, সেই সিস্টেম না ভাঙ্গা পর্যন্ত দু’একজন মানুষের আলাদা কাজ-কারবারে তেমন কিছুই হয় না। সেখানকার পরিচালক ও কর্মচারীদের বাদ দিয়ে নতুন মানুষ আনলেও অবস্থার কোনই উত্তরণ ঘটবে না। সিস্টেম না পল্টিয়ে ঐ মানুষ পাল্টালে দৃশ্যপট কিছুই পাল্টাবে না। কেননা ঘাপলাটা দু’একজনের সততার সমস্যায় নয়, সমস্যা আসলে সিস্টেমের।
গ্রামীন ফোন, বাংলালিংক, একটেলরা টেলিটকের সাথে প্রতিযোগীতায় কখনোই টিকতে পারতো না। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সবসময়ই এটাই চায়- একটা অবাধ প্রতিযোগীতাহীন মার্কেট। সেজন্যই তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান নিয়ে এত এলার্জী। সেকারণেই বিশ্বব্যাংকের প্রথম ও প্রধান শর্তই থাকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারী করতে হবে। গ্যাটস চুক্তিরও মূল ধারাই প্রাইভেটাইজেশন! এখানে নোবেল বিজয়ী, আমাদের তথাকথিত গর্ব(!!) ইউনুস, মোর্শেদ সহ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের নানাধরণের দালালেরা, সরকারে থাকা সুবিধাভোগীরা, ওদের কেনা গোলাম আমলারা তাদের হয়ে একাজটি সহজ করে দিয়েছে; ওদের কারণেই টেলিটক বাজারে আসতে এত দেরী হয়, গ্রামীন ফোন, বাংলালিংক, একটেল, সিটিসেলরা এত সহজে, আরামে এবং এত সুবিধা নিয়ে এখানে অবাধে ব্যবসা করে যেতে পারে!
রাষ্ট্র সাবসিডি দেয় মানে জনগণের টাকাই সে এলোকেট করে। কেননা রাষ্ট্রের টাকা মানে জনগণেরই টাকা। আবার রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান মানেও কিন্তু জনগণেরই প্রতিষ্ঠান। ফলে, জনগণের প্রতিষ্ঠানকে ভালো করে চালাতে যদি জনগণের টাকা সাবসিডি আকারে যায়, আমি আপত্তির কিছু দেখি না। কিন্তু জনগণের টাকা যদি- ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে যায়- বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে যায়- সেটা অনেক আপত্তিকর। সেটা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
এরই মাঝে বিতর্কিত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) বিল ২০১০ সংসদে উত্থাপিত হয়েছে গত ১৩ জুন। এরপর বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটি বিষয়টি নিয়ে এ পর্যন্ত চারটি বৈঠক করেছে। এর দুটি বৈঠক হয়েছে বিটিআরসি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে। টেলিযোগাযোগ নীতিমালার ৪.২.২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘টেলিযোগাযোগ নিয়ামক কমিশন এমন একটি স্বশাসিত কমিশন হইবে যাহা ইহার স্বাধীনতা বজায় রাখিবে। কমিশনের প্রধান এবং অন্যান্য সদস্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নিয়োগপ্রাপ্ত হইবেন।’ অপরদিকে, প্রস্তাবিত আইনে প্রতিষ্ঠানটিকে ক্ষমতা শূন্য করা হয়েছে। টেলিযোগাযোগ লাইসেন্স দেয়া, ফি ও ট্যারিফ নির্ধারণ, পরামর্শক নিয়োগ এবং প্রবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা বিটিআরসির কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মন্ত্রণালয়কে দেয়া হয়েছে। লাইসেন্সের শর্তাবলী সংশোধন এবং লাইসেন্স বাতিল বা স্থগিত করার ক্ষমতাও সরকারের কাছে দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন সংসদে পাস হলে বিটিআরসির আর তেমন কোনো কাজ থাকবে না। বিটিআরসিকে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। দ্বৈত কর্তৃত্বের কারণে যে কোনো কাজে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হবে। ফলে কমিশনের কর্মকাণ্ড আরো স্থবির হয়ে পড়বে। যা এই খাতের জন্য হবে এক অপূরণীয় ক্ষতি। প্রস্তাবিত আইনটি মূলতঃ টেলিযোগাযোগ নীতিমালা ১৯৯৮-এর পরিপন্থী। বিটিআরসি এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১ জাতীয় টেলিযোগাযোগ নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। নীতিমালায় কমিশনকে (বিটিআরসি) টেলিযোগাযোগ আইনের অভিভাবক উল্লেখ করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, কমিশন হবে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত। যে কারণে সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবিত আইনটি টেলিযোগাযোগ নীতিমালার পরিপন্থী।
বর্তমান সরকার আমাদের মত প্রকশের স্বাধীনতায় কতটা সোচ্চার (!), তা হয়তো ইতোমধ্যেই আমাদের বোধগম্য হয়েছে। সরকারের কাজের সমালোচনা করা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম বন্ধ হতে আমরা দেখেছি, আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ক্ষমতার জোরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের বন্ধ হয়ে যাওয়া। নির্ভরযোগ্য সুত্র মতে, সরকারের আই টি বিশেষজ্ঞরা (!) প্রায় শতাধিক ওয়েব সাইটকে (সংবাদ ভিত্তিক+ম্যাগাজিন+ব্লগ) সরকারের জন্য হুমকি স্বরূপ জানিয়ে ইতোমধ্যে এগুলো বন্ধ করার কাজ শুরু করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, বন্ধ হয়ে যাওয়া বা হতে যাওয়া ওয়েব সাইটগুলোর বেশির ভাগই বাম ভাবাপন্ন।
উপরের আলোচনা থেকে একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মোবাইল শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে ঋণাত্মক ভূমিকা রাখছে। বিদেশী কোম্পানিগুলোর এই ব্যবসার ফলে আমরা প্রতি মাসে বিরাট অংকের টাকা হারাচ্ছি; আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে, বৈদেশিক রিজার্ভ কমছে, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। রিজার্ভ কমা ও মূল্যস্ফীতি বাড়ার অনেক কারণের এটাও অন্যতম প্রধান কারণ। এখানে বিনিয়োগকারী বিদেশী, তারা সেবা বিক্রি করছে, আমরা সেবা কিনছি। সেবা কিনছি নগদ অর্থ দিয়ে, যেহেতু কিনছি বিদেশীদের কাছ থেকে, সেহেতু তা আমদানী- এবং তার ফলাফলও নেগেটিভ। এর পরোক্ষ প্রভাবও গৌণ। এই অর্থনৈতিক ঋণাত্বকতার দায়দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সরকারগুলোকেই। যার প্রধান কারণ হলো এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা। তারা দেশী ও বিদেশী উভয় গুরুর কাছেই নতজানু(লোভে-লাভে)। এই যখন রাষ্ট্রীয় মনোভাব সেখানে সাধারণের আশার জায়গাটা নিতান্তই নগণ্য। তবু মানুষ আশায় বুক বুক বাঁধে, নতুন করে বাঁচার আশায়। তাই আমাদের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। দরকার সচেতনতা ও আত্মোপলব্ধি, যার দ্বারা ঐ সরকারগুলোকে বাধ্য করতে পারি নতজানু না হতে, নচেৎ তাদেরকে উচ্ছেদ করতে।।
উৎসর্গঃ মহান বিপ্লবী কমরেড চে গুয়েভারা (আজকের দিনেই (৯/১০/৬৭ইং) সাম্রাজ্যবাদের পা চাটা কুত্তারা তাঁকে হত্যা করছিল)
৯/১০/১০ইং
(বি.দ্রঃ মূল লেখাটি গত বছরের (২০০৯) শেষাংশে লেখা, যা পর্যায়ক্রমে সংযুক্তির মাধ্যমে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে)
বখাটে উৎপাত (সমাজের কীট), যৌন সন্ত্রাস ও আমাদের করণীয় / শাহেরীন আরাফাত
আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে দীর্ঘকাল ধরে। কখনো তা হয়েছে প্রকাশিত, আবার কখনো বা থেকেছে অপ্রকাশিত। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে, তাতে তেমন কোন ভাটা লক্ষ্য করা যায়নি। কোথাও না কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা অহরহই ঘটে চলেছে। নানাভাবে নানাপন্থায় নির্যাতন চলে নারীদের ওপর। নারীদের নির্যাতনের বিভিন্ন পন্থার মধ্যে খুন, ধর্ষণ, এ্যাসিড নিক্ষেপ, শারীরিক নির্যাতন, বখাটেদের দ্বারা যৌন হয়রানী ইত্যাদি নানা দিক রয়েছে। তবে বখাটেদের উৎপাত সাম্প্রতিককালে সমগ্র দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বখাটেদের অত্যাচারের ব্যাপারটি মাঝেমধ্যেই এমন পর্যায়ে চলে যায়, যার জন্য কিশোরী-তরুণীদের জীবন পর্যন্ত দিতে হয়। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এমন বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে আমাদের দেশে, যা আমাদের হতবাক করেছে, করেছে ব্যথিত। এ মুহূর্তে সারা দেশে নারী উৎপীড়ক যৌন সন্ত্রাসীদের কর্মকান্ড সবার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। অতিসম্প্রতি একই কায়দায় যৌন সন্ত্রাসীদের দ্বারা খুন হয়েছেন ফরিদপুরে চাঁপা রানী ভৌমিক নামের একজন মা ও নাটোরের কলেজশিক্ষক মিজানুর রহমান। এর কয়েক মাস আগে ভিকারুননিসা নুন স্কুলের এক ছাত্রীকে স্কুল ছুটির পর বাসায় যাওয়ার পথে অপহরণ করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। শুধু অপহরণই করেনি, পরে তার নগ্ন ছবি তুলে ভিডিও চিত্র ধারণ করে সিডি বানিয়ে তার বাসায় দিয়ে গেছে। এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে এই কারণে অনেক স্কুল-কলেজছাত্রীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাওয়াও প্রায় বন্ধের মুখে। তবে বেশির ভাগ ঘটনায়ই অভিভাবকরা মামলা করতে চান না, বা সাহস করেন না। কেননা, মামলার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। উপরন্তু, সেই প্রভাবশালী যৌন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নিতে মেয়ের অভিভাবকদের উপর চাপ সৃষ্টি করে। তবে এ ব্যাপারে শুধু আইন দিয়েই হবে না, প্রয়োজন আরও বেশি সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ। এখন অবশ্য সমাজে কিছুটা সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে তা এখনো অপ্রতুল।
বখাটেদের উৎপাতে একের পর এক তরুণীর আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। শুধু আত্মহত্যাই নয়, আরও কয়েকটি হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ, ২৭ অক্টোবর যৌন হয়রানীর প্রতিবাদ করায় শিক্ষক মিজানুর রহমানের পর যৌন সন্ত্রাসীদের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় প্রাণ দিলেন এক মা। ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলা সদরে সন্ত্রাসী দেবাশীষ সাহা রনির মোটরসাইকেলের ধাক্কায় চাঁপা রানী ভৌমিক মারা যান। এর আগে গত ৫ই এপ্রিল কিশোরগঞ্জে দশম শ্রেণীর ছাত্রী মরিয়ম আক্তার পিংকি'কে দৃশ্যত এক বখাটে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়, ফলে পিংকি'র মৃত্যু ঘটে৷ এপ্রিল মাসেই বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি না দেয়ায় গুলশানে এক তরুণীকে ও তার মা-বাবাকে হত্যা করেছে এক যুবক। এ ঘটনার প্রায় পরপর কলাবাগানেও একইভাবে বাড়িতে ঢুকে হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে তরুণীকে ও তার মা-বাবাকে।
পূর্ববর্তীকালে, মেয়ের অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন পিরোজপুরের কাউখালীর এক হতভাগ্য বাবা সুধীর শিকদার। বখাটে যুবকের উৎপাত এবং হুমকিতে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে গত ১৯ জানুয়ারী শ্যামলী আইডিয়াল টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্রী নাসফিয়া আকন্দ পিংকি (১৪) নামের এক কিশোরী; ৭ মার্চ বগুড়া জেলার শেরপুরের শালফা টেকনিক্যাল এ্যান্ড বিকম কলেজের শিক্ষার্থী এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রেশমা; ৬ মার্চ বখাটে উৎপাতের শিকার হয়ে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেছে শেরপুর উপজেলার গজারিয়া-বড়ইতলী গ্রামের রিকশাভ্যান চালক মো. আবদুল জলিলের কিশোরী কন্যা রেশমা আক্তার (১৮); ১৭ মার্চ বখাটেদের নির্যাতন সইতে না পেরে ভট্টাচার্য্য পাড়ার চাঁদমনি নামে এক স্কুল ছাত্রী আত্মহত্যা করেন; গাইবান্ধার এক মাদ্রাসার ছাত্রী নুরিনা আক্তার মাত্র ১৪ বছর বয়সে নিজের ওড়নার ফাঁস গলায় দিয়ে আত্মহত্যা করেছে; গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী উম্মে কুলসুম ইলোরা বখাটেদের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে; এ প্রসঙ্গে আরো স্মরণ করা যায় সিমি, ইন্দ্রানী, তৃষাসহ আরও অনেক বালিকা-কিশোরীর কথা, যারা ঐ উৎপীড়কদের শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডগুলোতে জড়িত যৌন সন্ত্রাসী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থেকেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অর্থের জোরে, অথবা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে।
এভাবে বখাটে যুবকদের লালসার বলি হয়ে একের পর এক প্রাণ হারাচ্ছে বহু সম্ভাবনাময় কিশোরী তরুণী। সংবাদপত্রের ভাষায় এ বখাটেদের দুর্বৃত্তপনাকে 'ইভটিজিং' বলে অভিহিত করা হয়। তবে আমার মতে, “ইভটিজিং” বলে অবস্থার ভয়াবহতাকে যেন লঘু করেই দেখা হয়। ভাবখানা এমন যে, ছেলেরা তো মেয়েদের একটু-আধটু উৎপীড়ণ করবেই!!!
কিন্তু কোন সভ্য সমাজে বিষয়টাকে এমনভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। এটা কোন মধ্যযুগীয় বর্বর সমাজ নয় যে, একটি মেয়ে দেখলে তার ওপর কোন যুবক ঝাঁপিয়ে পড়বে। যৌন সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডে বাধা দিলে, তাদের প্রতিরোধ করতে গেলে অভিভাবক, শিক্ষকদের হত্যা করা হবে, প্রেমে সম্মতি না দিলেই তার ওপর নির্যাতন করবে, নয়তো এসিড ছুড়ে মারবে, নয়তো কেরোসিন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে। এমন বর্বরতা কোন সভ্য সমাজে চলতে পারে না।
বখাটেদের অত্যাচারে রাজধানীসহ সমগ্রদেশে অনেক মেয়ের সম্ভাবনাময় জীবন শেষ হয়ে গেছে। আজকের এই যুগে মেয়েরা লেখাপড়া চাকরি ব্যবসাসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে পুরুষের পাশাপাশি। দুর্বৃত্ত বখাটেরা মেয়েদের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করছে, তাদের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলছে। বখাটেদের উৎপাতে স্কুলগামী বহু মেয়ের জীবন, নিরাপত্তা, সম্ভ্রম, মর্যাদা রক্ষা করা এখন কঠিন হয়ে পড়ছে। এদের সমাজ থেকে উৎখাত করতে হবে। এদের বিরুদ্ধে আইগত ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
সমাজের সর্বত্র প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে এর প্রতিবাদে এবং অপরাধীদের শাস্তির দাবীতে মানববন্ধন হচ্ছে, যার সচিত্র প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়ে আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের লজ্জা ও গ্লানির বোঝা বাড়াচ্ছে। যে সমাজে নারী তার প্রকৃতি প্রদত্ত মর্যাদা, অধিকার, সম্ভ্রম, ইজ্জত রক্ষা করে চলতে পারে না, কোথাও নিরাপদ আশ্রয় পায় না, সে সমাজকে সভ্য-সংস্কৃতি সম্পন্ন মানব সমাজ বলা যায় না।
পর্যায়ক্রমে এসব ঘটনা ঘটে চললেও সমাজ, পরিবার, সরকার, আইন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেহই এ বেদনাদায়ক অবস্থার কোন প্রতিকার করতে পারছেন না। ফলে পরিস্থিতি দিন দিন আরো ঘোরালো হয়ে উঠছে। প্রশ্ন উঠছে, এই অসামাজিক বখাটেপনা, যৌন সন্ত্রাস কি ভাবে রোধ করা যাবে? অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শৈথিল্য যে অনেকাংশে দায়ী তা ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না। তবে ঘটনাগুলোর অভ্যন্তরে রয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক নানা কারণ।
রাষ্ট্রের দূষণে সৃষ্ট ভঙ্গুর সমাজের বাই-প্রডাক্ট এই যৌন উৎপীড়ণ সন্ত্রাস। সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা দূর করতে আমাদের অবশ্যই সমস্যার গভীরে যেতে হবে, ঐসব অপরাধ প্রবণতার উৎসমুখ চিহ্নিত করতে হবে। আর তা করতে আমাদের সমাজের পরিবর্তনশীল ক্ষেত্রগুলোর দিকে নজর দেওয়া দরকার। প্রতি মূহুর্তে আমাদের একটি বিশাল জনগোষ্ঠি গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে নগরের পাণে ছুটছে। পক্ষান্তরে, নগরবাসীর সংখ্যা বাড়লেও নাগরিক সমাজ ও নাগরিক সমাজে যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হওয়ার কথা তা হয়নি, নাগরিক সমাজের অবয়বও দাঁড়ায়নি।
উপরন্তু, ষাট বা সত্তরের দশকে এদেশের ছাত্র সমাজ বা যুব সমাজ স্বদেশপ্রেমের যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল, বর্তমানে সেই ছাত্র সমাজে তেমন ইতিবাচক কোন নীতি খঁজে পাওয়া দুষ্কর হলেও শুধু লেজুড়বৃত্তি, দলবাজি, চাঁদাবাজী ও টেন্ডারবাজী। ক্ষমতার লোভে-লাভে আদর্শিক রাজনীতি এখন কদাচিৎ বর্তমান। রাজনীতির ব্যবসায়করণের ফলে তা এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে; যা শুধু রাজনীতিকেই নয়, শিক্ষাঙ্গণকেও ক্রমশ আদর্শহীন করে চলেছে। বিদেশে গিয়ে টাকার মালিক হওয়াই এই শিক্ষার লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। আর ছাত্র রাজনীতি পরিণত হয়েছে ক্যাডারের রাজনীতিতে; সেখানে শেখানো হয় টেন্ডারবাজী, বোমাবাজী, লেজুরবৃত্তি। তারা মূলত তাদের পূর্বসুরী নেতাদেরই অনুসরণ করেন। যৌন হয়রানি সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতরা সমাজের একটি খুবই ক্ষুদ্র অংশ, কিন্তু প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না থাকায় ক্রমশ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে এই অংশটির থাবা। আমাদের মনে রাখতে হবে, সব সন্ত্রাসের উৎসমুখ এক। তাই চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, মাস্তানী বাড়লে বখাটেপণাও বাড়বে। বর্তমানে অনেক নারী ও মানবাধিকার সংগঠনই এক একটি এনজিও-তে পরিণত হয়েছে আর এই সংগঠনগুলো ঐ ঘুণে ধরা রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধ্বজাধারীদের পক্ষে। কোন অজানা কারণে তারা এই বিষম পরিস্থিতিতেও নীরব ভূমিকা পালন করছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার এহেন অব্যবস্থার মাঝে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পরা নোংড়ামী থেকে উৎপন্য যৌন সন্ত্রাসের জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী হল সেই দূষিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যেখানে সাধারণের অধিকার বড়ই সীমিত।
যৌন হয়রানী বন্ধের জন্য শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তাই সব নয়; তা আমাদের সবার, বিশেষ করে সরকারের মন্ত্রীদের বুঝতে হবে। শুধু আইন প্রয়োগ করে এ ব্যাধি সমাজ দেহ থেকে দূর করা যাবে না। এপ্রসঙ্গে প্রশ্ন করায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ উপ-পরিদর্শকের বক্তব্য প্রনিধানযোগ্য, “আমাদের অধিকাংশ অফিসার মন্ত্রী-এম.পি, আমলা, এমন কি সরকার দলীয় পাতি নেতাদের বাসায় ডউটি করে; আমরা সাধারণ মানুষকে সাহায্য করব কখন?”
এ দুর্বৃত্ত আচরণ বন্ধে অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ জরুরি। এজন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষ, সরকার ও প্রশাসনকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধারাবাহিক নিরলস প্রয়াস চালাতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যদি তৎপর হয়, কঠোর আইনপূ্বক অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায় এবং তাকে অপরাধের সুযোগ না দেওয়া হয় তবেই এই প্রবণতা কমে আসবে। আর তাই সামাজিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রত্যেক পরিবারে ও সমাজে মানবিক মূল্যবোধ, সুরুচি ও শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা আবশ্যক। পরিবার থেকেই তৈরী হয় সামাজিক মানুষ। সমাজকে পাশে পায়নি বলেই অকালে আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হয়েছে এইসব কিশোরীরা। লজ্জা, অপমান ও গ্লানিতে বাকহারা হয়ে পড়েছে তাদের পরিবার। রাষ্ট্র ও সমাজ এ অবস্থায় নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। এর প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুবিস্তৃত প্রতিরোধের পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমগুলিতে ব্যাপক আকারে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে নারীর প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টিকে দৃঢ়মূল করতে হবে।
প্রতিটি পাড়ায়-মহল্লায় বখাটেদের উৎপাত বন্ধে সচেতনতা কর্মসূচি এলাকার জনগণের মধ্য থেকে গ্রহণ করা উচিত। কোন মেয়ে উত্ত্যক্ত হলে এলাকার সচেতন, শিক্ষিত, দায়িত্বশীল মানুষকে মেয়েটি ও তার অভিভাবকদের পাশে এবং যৌন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। কোন কোন এলাকায় জনসাধারণ প্রতিরোধ গড়ে তুলে বখাটেদের উৎপাত বন্ধ করতে পেরেছে এমন দু-একটি সংবাদ আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি, যা আশার সঞ্চারক। তাই মানুষের মধ্যে এমন প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ঘটনা ঘটলে নয়, ঘটবার আগেই সমাজের মানুষকে, বিদ্যালয়, পরিবার ও পুলিশকে তৎপর হতে হবে আর এর কোন বিকল্প নাই। সকলের সংঘবদ্ধ আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই আমরা রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি যেন সে তার ‘যৌন সন্ত্রাস’ নামক বাই-প্রডাক্ট এর প্রডাকশন বন্ধ করে…
বখাটেদের উৎপাতে একের পর এক তরুণীর আত্মহত্যার ঘটনা আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। শুধু আত্মহত্যাই নয়, আরও কয়েকটি হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। সর্বশেষ, ২৭ অক্টোবর যৌন হয়রানীর প্রতিবাদ করায় শিক্ষক মিজানুর রহমানের পর যৌন সন্ত্রাসীদের মোটরসাইকেলের ধাক্কায় প্রাণ দিলেন এক মা। ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলা সদরে সন্ত্রাসী দেবাশীষ সাহা রনির মোটরসাইকেলের ধাক্কায় চাঁপা রানী ভৌমিক মারা যান। এর আগে গত ৫ই এপ্রিল কিশোরগঞ্জে দশম শ্রেণীর ছাত্রী মরিয়ম আক্তার পিংকি'কে দৃশ্যত এক বখাটে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়, ফলে পিংকি'র মৃত্যু ঘটে৷ এপ্রিল মাসেই বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি না দেয়ায় গুলশানে এক তরুণীকে ও তার মা-বাবাকে হত্যা করেছে এক যুবক। এ ঘটনার প্রায় পরপর কলাবাগানেও একইভাবে বাড়িতে ঢুকে হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে তরুণীকে ও তার মা-বাবাকে।
পূর্ববর্তীকালে, মেয়ের অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন পিরোজপুরের কাউখালীর এক হতভাগ্য বাবা সুধীর শিকদার। বখাটে যুবকের উৎপাত এবং হুমকিতে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে গত ১৯ জানুয়ারী শ্যামলী আইডিয়াল টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্রী নাসফিয়া আকন্দ পিংকি (১৪) নামের এক কিশোরী; ৭ মার্চ বগুড়া জেলার শেরপুরের শালফা টেকনিক্যাল এ্যান্ড বিকম কলেজের শিক্ষার্থী এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী রেশমা; ৬ মার্চ বখাটে উৎপাতের শিকার হয়ে কীটনাশক পান করে আত্মহত্যা করেছে শেরপুর উপজেলার গজারিয়া-বড়ইতলী গ্রামের রিকশাভ্যান চালক মো. আবদুল জলিলের কিশোরী কন্যা রেশমা আক্তার (১৮); ১৭ মার্চ বখাটেদের নির্যাতন সইতে না পেরে ভট্টাচার্য্য পাড়ার চাঁদমনি নামে এক স্কুল ছাত্রী আত্মহত্যা করেন; গাইবান্ধার এক মাদ্রাসার ছাত্রী নুরিনা আক্তার মাত্র ১৪ বছর বয়সে নিজের ওড়নার ফাঁস গলায় দিয়ে আত্মহত্যা করেছে; গত ৩ এপ্রিল রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী উম্মে কুলসুম ইলোরা বখাটেদের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে; এ প্রসঙ্গে আরো স্মরণ করা যায় সিমি, ইন্দ্রানী, তৃষাসহ আরও অনেক বালিকা-কিশোরীর কথা, যারা ঐ উৎপীড়কদের শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডগুলোতে জড়িত যৌন সন্ত্রাসী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থেকেছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অর্থের জোরে, অথবা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে।
এভাবে বখাটে যুবকদের লালসার বলি হয়ে একের পর এক প্রাণ হারাচ্ছে বহু সম্ভাবনাময় কিশোরী তরুণী। সংবাদপত্রের ভাষায় এ বখাটেদের দুর্বৃত্তপনাকে 'ইভটিজিং' বলে অভিহিত করা হয়। তবে আমার মতে, “ইভটিজিং” বলে অবস্থার ভয়াবহতাকে যেন লঘু করেই দেখা হয়। ভাবখানা এমন যে, ছেলেরা তো মেয়েদের একটু-আধটু উৎপীড়ণ করবেই!!!
কিন্তু কোন সভ্য সমাজে বিষয়টাকে এমনভাবে দেখার কোন সুযোগ নেই। এটা কোন মধ্যযুগীয় বর্বর সমাজ নয় যে, একটি মেয়ে দেখলে তার ওপর কোন যুবক ঝাঁপিয়ে পড়বে। যৌন সন্ত্রাসীদের কর্মকাণ্ডে বাধা দিলে, তাদের প্রতিরোধ করতে গেলে অভিভাবক, শিক্ষকদের হত্যা করা হবে, প্রেমে সম্মতি না দিলেই তার ওপর নির্যাতন করবে, নয়তো এসিড ছুড়ে মারবে, নয়তো কেরোসিন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে। এমন বর্বরতা কোন সভ্য সমাজে চলতে পারে না।
বখাটেদের অত্যাচারে রাজধানীসহ সমগ্রদেশে অনেক মেয়ের সম্ভাবনাময় জীবন শেষ হয়ে গেছে। আজকের এই যুগে মেয়েরা লেখাপড়া চাকরি ব্যবসাসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে পুরুষের পাশাপাশি। দুর্বৃত্ত বখাটেরা মেয়েদের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করছে, তাদের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলছে। বখাটেদের উৎপাতে স্কুলগামী বহু মেয়ের জীবন, নিরাপত্তা, সম্ভ্রম, মর্যাদা রক্ষা করা এখন কঠিন হয়ে পড়ছে। এদের সমাজ থেকে উৎখাত করতে হবে। এদের বিরুদ্ধে আইগত ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
সমাজের সর্বত্র প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে এর প্রতিবাদে এবং অপরাধীদের শাস্তির দাবীতে মানববন্ধন হচ্ছে, যার সচিত্র প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়ে আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের লজ্জা ও গ্লানির বোঝা বাড়াচ্ছে। যে সমাজে নারী তার প্রকৃতি প্রদত্ত মর্যাদা, অধিকার, সম্ভ্রম, ইজ্জত রক্ষা করে চলতে পারে না, কোথাও নিরাপদ আশ্রয় পায় না, সে সমাজকে সভ্য-সংস্কৃতি সম্পন্ন মানব সমাজ বলা যায় না।
পর্যায়ক্রমে এসব ঘটনা ঘটে চললেও সমাজ, পরিবার, সরকার, আইন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেহই এ বেদনাদায়ক অবস্থার কোন প্রতিকার করতে পারছেন না। ফলে পরিস্থিতি দিন দিন আরো ঘোরালো হয়ে উঠছে। প্রশ্ন উঠছে, এই অসামাজিক বখাটেপনা, যৌন সন্ত্রাস কি ভাবে রোধ করা যাবে? অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শৈথিল্য যে অনেকাংশে দায়ী তা ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না। তবে ঘটনাগুলোর অভ্যন্তরে রয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক নানা কারণ।
রাষ্ট্রের দূষণে সৃষ্ট ভঙ্গুর সমাজের বাই-প্রডাক্ট এই যৌন উৎপীড়ণ সন্ত্রাস। সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধপ্রবণতা দূর করতে আমাদের অবশ্যই সমস্যার গভীরে যেতে হবে, ঐসব অপরাধ প্রবণতার উৎসমুখ চিহ্নিত করতে হবে। আর তা করতে আমাদের সমাজের পরিবর্তনশীল ক্ষেত্রগুলোর দিকে নজর দেওয়া দরকার। প্রতি মূহুর্তে আমাদের একটি বিশাল জনগোষ্ঠি গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে নগরের পাণে ছুটছে। পক্ষান্তরে, নগরবাসীর সংখ্যা বাড়লেও নাগরিক সমাজ ও নাগরিক সমাজে যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হওয়ার কথা তা হয়নি, নাগরিক সমাজের অবয়বও দাঁড়ায়নি।
উপরন্তু, ষাট বা সত্তরের দশকে এদেশের ছাত্র সমাজ বা যুব সমাজ স্বদেশপ্রেমের যে আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিল, বর্তমানে সেই ছাত্র সমাজে তেমন ইতিবাচক কোন নীতি খঁজে পাওয়া দুষ্কর হলেও শুধু লেজুড়বৃত্তি, দলবাজি, চাঁদাবাজী ও টেন্ডারবাজী। ক্ষমতার লোভে-লাভে আদর্শিক রাজনীতি এখন কদাচিৎ বর্তমান। রাজনীতির ব্যবসায়করণের ফলে তা এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে; যা শুধু রাজনীতিকেই নয়, শিক্ষাঙ্গণকেও ক্রমশ আদর্শহীন করে চলেছে। বিদেশে গিয়ে টাকার মালিক হওয়াই এই শিক্ষার লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। আর ছাত্র রাজনীতি পরিণত হয়েছে ক্যাডারের রাজনীতিতে; সেখানে শেখানো হয় টেন্ডারবাজী, বোমাবাজী, লেজুরবৃত্তি। তারা মূলত তাদের পূর্বসুরী নেতাদেরই অনুসরণ করেন। যৌন হয়রানি সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতরা সমাজের একটি খুবই ক্ষুদ্র অংশ, কিন্তু প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না থাকায় ক্রমশ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে এই অংশটির থাবা। আমাদের মনে রাখতে হবে, সব সন্ত্রাসের উৎসমুখ এক। তাই চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, মাস্তানী বাড়লে বখাটেপণাও বাড়বে। বর্তমানে অনেক নারী ও মানবাধিকার সংগঠনই এক একটি এনজিও-তে পরিণত হয়েছে আর এই সংগঠনগুলো ঐ ঘুণে ধরা রাষ্ট্র ব্যবস্থার ধ্বজাধারীদের পক্ষে। কোন অজানা কারণে তারা এই বিষম পরিস্থিতিতেও নীরব ভূমিকা পালন করছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার এহেন অব্যবস্থার মাঝে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পরা নোংড়ামী থেকে উৎপন্য যৌন সন্ত্রাসের জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী হল সেই দূষিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা, যেখানে সাধারণের অধিকার বড়ই সীমিত।
যৌন হয়রানী বন্ধের জন্য শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয়তাই সব নয়; তা আমাদের সবার, বিশেষ করে সরকারের মন্ত্রীদের বুঝতে হবে। শুধু আইন প্রয়োগ করে এ ব্যাধি সমাজ দেহ থেকে দূর করা যাবে না। এপ্রসঙ্গে প্রশ্ন করায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ উপ-পরিদর্শকের বক্তব্য প্রনিধানযোগ্য, “আমাদের অধিকাংশ অফিসার মন্ত্রী-এম.পি, আমলা, এমন কি সরকার দলীয় পাতি নেতাদের বাসায় ডউটি করে; আমরা সাধারণ মানুষকে সাহায্য করব কখন?”
এ দুর্বৃত্ত আচরণ বন্ধে অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ জরুরি। এজন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষ, সরকার ও প্রশাসনকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধারাবাহিক নিরলস প্রয়াস চালাতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যদি তৎপর হয়, কঠোর আইনপূ্বক অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া যায় এবং তাকে অপরাধের সুযোগ না দেওয়া হয় তবেই এই প্রবণতা কমে আসবে। আর তাই সামাজিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রত্যেক পরিবারে ও সমাজে মানবিক মূল্যবোধ, সুরুচি ও শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা আবশ্যক। পরিবার থেকেই তৈরী হয় সামাজিক মানুষ। সমাজকে পাশে পায়নি বলেই অকালে আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হয়েছে এইসব কিশোরীরা। লজ্জা, অপমান ও গ্লানিতে বাকহারা হয়ে পড়েছে তাদের পরিবার। রাষ্ট্র ও সমাজ এ অবস্থায় নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারে না। এর প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুবিস্তৃত প্রতিরোধের পরিকল্পনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমগুলিতে ব্যাপক আকারে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে নারীর প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টিকে দৃঢ়মূল করতে হবে।
প্রতিটি পাড়ায়-মহল্লায় বখাটেদের উৎপাত বন্ধে সচেতনতা কর্মসূচি এলাকার জনগণের মধ্য থেকে গ্রহণ করা উচিত। কোন মেয়ে উত্ত্যক্ত হলে এলাকার সচেতন, শিক্ষিত, দায়িত্বশীল মানুষকে মেয়েটি ও তার অভিভাবকদের পাশে এবং যৌন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। কোন কোন এলাকায় জনসাধারণ প্রতিরোধ গড়ে তুলে বখাটেদের উৎপাত বন্ধ করতে পেরেছে এমন দু-একটি সংবাদ আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি, যা আশার সঞ্চারক। তাই মানুষের মধ্যে এমন প্রতিরোধ গড়ে তোলার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। ঘটনা ঘটলে নয়, ঘটবার আগেই সমাজের মানুষকে, বিদ্যালয়, পরিবার ও পুলিশকে তৎপর হতে হবে আর এর কোন বিকল্প নাই। সকলের সংঘবদ্ধ আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমেই আমরা রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি যেন সে তার ‘যৌন সন্ত্রাস’ নামক বাই-প্রডাক্ট এর প্রডাকশন বন্ধ করে…
৭ই নভেম্বর কি এবং কেন??? / শাহেরীন আরাফাত
৭ই নভেম্বর, বাংলার ইতিহাসের এক অনন্য দিন। কারো মতে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের সূচনা, আবার কারো মতে তা বিপ্লব ও সংহতি দিবস। বিএনপির পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়, এই দিনে সিপাহি-জনতার উত্থানের মধ্য দিয়ে একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, ফলে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে এবং সার্বভৌমত্ব-স্বাধীনতা রক্ষা পায়। ৭ নভেম্বর বিএনপি জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করলেও এই বিপ্লব সংঘটনের অপরাধেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম ও তাঁর রাজনৈতিক দল জাসদের নেতৃবৃন্দকে এক প্রহসনের বিচারের মধ্য দিয়ে কর্নেল তাহেরকে বেআইনিভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ঐ দিনের ঘটনাক্রম ছিল পাকিস্তান আমল বা স্বাধীন বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বুর্জোয়া রাজনৈতিক টানাপোড়েন থেকে একদমই ভিন্ন। সেদিন সমাজতন্ত্রের আদর্শে লালিত কমরেড ও মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত সেনা সদস্যরা একটি ভিন্ন লক্ষ্যে এগিয়ে আসে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের চরম দুর্ভোগ, চাটুকার ঘেরা তৎকালীন সরকার, রাষ্ট্র দ্রোহীতার দায়ে জাসদের (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) নিষিদ্ধকরণ ও দমন নিপীড়ণের স্বার্থে দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থকদের হত্যা এবং মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে কতগুলো অভ্যুত্থান আর রক্তপাতের বিরুদ্ধে ছিল তাদের তীব্র ঘৃণা; আর এরই ফলশ্রুতিতে জাতীয় জীবনে পরিপূর্ণ মুক্তির লক্ষ্যে তাদের এই প্রচেষ্টা।
মূলত ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মূলে ছিল জাসদের সশস্ত্র শাখা। এই বিদ্রোহের মাধ্যমেই প্রথম বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনী প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশ করে। দু’টি সংগঠনই মুক্তিযুদ্ধে দোর্দণ্ড প্রতাপে নেতৃত্বদানকারী-অংশগ্রহণকারীদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল। তৎকালীন সিনিয়র সামরিক অফিসারদের অনেকেই বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত ছিলেন, এবং বিদেশী গোয়েন্দাদের সঙ্গেও যোগসাজশ ছিল তাদের। যারা ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে সাধারণ সৈন্য ছিলেন। তাদের সাহস, বীরত্ব আর আত্মত্যাগের যে গুণাবলী লক্ষ্য করা গেছে তা ঐ বিদ্রোহের এক বিশিষ্ট উত্তরাধিকার হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
এই বিষয়ে আলোচনার জন্য তৎকালীন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, নীতি নির্ধারণী মহলে অচলাবস্থা, শিক্ষার অভাগ, বেকারত্ব ছিল তখন চরম পর্যায়ে। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী জনগগোষ্ঠীর সংখ্যা ৭৮ শতাংশ। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচার করলে এরকম হতাশাব্যঞ্জক অর্থনৈতিক দৃষ্টান্তকে চ্যালেঞ্জ করা ছিল খুবই যৌক্তিক। উপরন্তু, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো সেনা ক্যু সংঘটিত হয়। শেখ মুজিবকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা দখলকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি তাহের। সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে এ রকম একটি ষড়যন্ত্রের আভাসও দিয়েছিলেন তাহের। কিন্তু কোনো সতর্কতা কাজে আসেনি, হত্যাকারীরা সফল হয়েছিল।সে সময় সেনাবাহিনীর মধ্যে একের পর এক সেনা ক্যু সংঘটিত হতে থাকে। এমতাবস্থায় দেশকে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন কর্নেল তাহের ও তার সহযোদ্ধারা।
৪ নভেম্বর থেকে আবু ইউসুফ এবং এ বি এম মহমুদের বাসায় শুরু হয় জাসদের নেতৃবৃন্দের লাগাতার মিটিং। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, ড. আখলাকুর রহমান, হাসানুল হক ইনু, আ ফ ম মাহবুবুল হক, খায়ের এজাজ মাসুদ, কাজী আরেফ প্রমুখ। আরো ছিলেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতা হাবিলদার হাই, কর্পোরাল আলতাফ, নায়েব সুবেদার মাহবুব, জালাল, সিদ্দিক প্রমুখ। তৎকালীন অন্যতম প্রধান দল জাসদ, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রত ছিল, তাদের যাত্রা প্রথমে বাধাগ্রস্ত হয়েছে শেখ মুজিব সরকারের সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক দলের প্রায় ২৬ হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থকদের হত্যা, নির্যাতনের কারণে এবং দ্বিতীয়বারের মতো রাজনীতির গতিপথ বদলে দেবার জন্য আবির্ভূত হন খালেদ মোশারফ। সে সময়ে সিপাহীরা স্পষ্টতই বুঝতে পারেন যে, তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। সৈনিকরা ক্রমেই হতাশাগ্রস্থ হয়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠছিল।
আবু ইউসুফের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় কমরেডদের সাথে মিটিং চলাকালে তাহের জানান, ২ তারিখ রাতে জেনারেল জিয়া তার জীবন রক্ষা করে গৃহবন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্য ফোনে ও পরে এক সুবেদারের মাধ্যমে এস ও এস ম্যাসেজের মাধ্যমে অনুরোধ করেন। ন্যাশনালিস্ট, সৎ অফিসার হিসেবে আর্মিতে তার একটা ইমেজ থাকায় তাহের জিয়াকেই সর্বাপেক্ষা উপযোগি বলে মনে করেন। তাহের জানান যে, জাসদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জেনারেল জিয়ার নীরব সমর্থন রয়েছে। তৎকালীন সময়ে জিয়ার পক্ষে জাসদের সিদ্ধান্তের বাইরে কিছু চিন্তা করাও সম্ভব ছিল না। গৃহ বন্দি জিয়াকে যে কোন সময়ে তাকে হত্যা করা হতে পারত, আর তাকে সে অবস্থা থেকে মুক্ত করতে পারত কেবল কর্নেল তাহের। মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয় যে, অভ্যুত্থান সফল হলে বিজয়ী সিপাহি জনতা কার নামে স্লোগান দেবে জিয়ার নামে। কারণ, তাহের অনেক আগেই আর্মি থেকে রিটায়ার্ড, ক্যান্টনমেন্টে তার নামে স্লোগান হলে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। অপরদিকে, জাসদের বড় নেতাদের মধ্যে জলিল, রব, শাজাহান সিরাজ তখন কারাগারে। জিয়া আর্মির লোক, তাকে জাসদ ও বিপ্লবী সৈনিকেরা মুক্ত করেছে, তাছাড়া সাধারণ মানুষের কাছেও তার একটা পরিচিতি ছিল। ঠান্ডা মাথায় পুরো অভ্যুত্থানের ছক তৈরি করেন তাহের। আসলো সেই ৭ই নভেম্বরের রাত। মধ্য রাতের পর জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করা হয় আর এর দায়িত্বে ছিলেন হাবিলদার হাই। তিনি ২০/৩০ জন সিপাই নিয়ে জিয়ার বাসভবনে যান। তারা স্লোগান দিতে দিতে আসেন ’কর্নেল তাহের লাল সালাম, জেনারেল জিয়া লাল সালাম’।
গভীর রাতে টেলিফোনের মাধ্যমে নিজের জীবন রক্ষার অনুরোধের প্রেক্ষিতে তাহের যে বাস্তবিকই তাকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন তা দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেন জেনারেল জিয়া। হাই জিয়াকে বলেন, কর্নেল তাহের এলিফ্যান্ট রোডে তার ভাইয়ের বাড়ীতে জেনারেল জিয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়েও উঠে পড়েন সৈনিকদের আনা গাড়িতে। মাঝপথে ফারুক, রশীদের এক সহযোগী মেজর মহিউদ্দীন এসে জিয়াকে বহনকারী গাড়িটিকে থামান। জিয়াকে টু ফিল্ড আর্টিলারীতে নিয়ে যাবার ব্যাপারে মেজর মহিউদ্দীন খুব তৎপর হয়ে উঠেন। সিপাহিরা খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। জিয়া টু ফিল্ড আর্টিলারীতে গিয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। জিয়া আর ক্যান্টনমেন্টের বাইরের কোন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ে যেতে চাইলেন না। জিয়া বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের বলেন কর্নেল তাহেরকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসতে। তাহের এই খবর পেয়ে ইনুকে বলেন, “এরা একটা রিয়েল ব্লান্ডার করে ফেলল। আমি চেয়েছিলাম আমাদের বিপ্লবের কেন্দ্রটাকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে আসতে।” টু ফিল্ড আর্টিলারীতে পৌঁছালে জিয়া এগিয়ে এসে তাহেরের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। জিয়া তাহেরকে বলেন, “তাহের, ইউ সেভড মাই লাইফ, থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।” তাহের বলেন, “আমি কিছুই করিনি, করেছে এই সিপাহিরা। অল ক্রেডিট গোজ টু দেম।” এরপর তাহের বসেন জিয়ার সঙ্গে আলাপে। কিভাবে তারা এই বিপ্লবটি সংগঠিত করেছেন তা জিয়াকে বিস্তারিত জানান। তাহের জিয়াকে পরেরদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা সমাবেশ করা এবং তাতে বক্তৃতা দেবার কথা বলেন। বক্তৃতার কথা শুনতেই জিয়া বেঁকে বসে। রেডিওতেও যেতে অস্বীকৃতি জানালেও পরে ক্যান্টনমেন্টেই রেকর্ড করা জিয়ার একটি বক্তৃতা প্রচার করা হয়েছে রেডিওতে। সেখানে জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষনা করেছেন। সিপাইদের অভ্যুত্থানের কথা বললেও বক্তৃতায় জিয়া কোথাও অভ্যুত্থানের পেছনে জাসদ কিম্বা কর্নেল তাহেরের কথা উল্লেখ করেন নি। উপমহাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় এই সিপাই অভ্যুত্থান ঘটবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সেটিকে বাঞ্চাল করে দেবার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে দুটি শক্তি, একদিকে জেনারেল জিয়া, আরেক দিকে খন্দকার মোশতাক। তাহেরকে না জানিয়ে গোপনে ক্যান্টনমেন্টে মিটিং করেন মেজর জেনারেল জিয়া, মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব, রিয়ার এডমিরাল এক এইচ খান, জেনারেল ওসমানী, মাহবুবুল আলম চাষী। হঠাৎ মিটিং এ তাহের উপস্থিত হলে মাহবুবুল আলম চাষী বলেন, “উই হ্যাব ডিসাইডেড টু কন্টিনিউ দি গভার্নমেন্ট উইথ মোশতাক এজ দি প্রেসিডেন্ট।” তাহের বলেন, “উই ক্যান নট এলাউ দিস নুইসেন্স টু গো অন ফর এভার।” জেনারেল ওসমানী তাহেরের চিন্তাভাবনা জানতে চাইলে তাহের বলেন, “প্রথমত আমাদের একটা বিপ্লবী পরিষদ করতে হবে, গঠন করতে হবে সর্বদলীয় জাতীয় সরকার। সে সরকারের কাজ হবে যত দ্রুত সম্ভব একটা ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশান দেওয়া। জাস্টিজ সায়েম আপাতত হেড অফ দি স্টেট থাকতে পারেন। জেনারেল জিয়া আর্মি চিফ থাকবেন।” ঘটনাক্রমে ক্ষমতা হাতে পাওয়া জিয়া নানান টাল বাহানায় বিপ্লবী সৈনিকদের দাবী দাওয়া মানতে অস্বীকৃতি জানায়। এ ঘটনায় আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকারী বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য, গনবাহিনীর সদস্যরা আওয়াজ তোলেন যে জেনারেল জিয়া ১২ দফা মানবার কথা দিয়ে কথা রাখেন নি, ওয়াদা খেলাপ করেছেন, প্রতারণা করেছেন তাদের সঙ্গে। অবশেষে তাহের সব বুঝতে পেরে বলেন, “এটা স্পষ্ট যে মূলত দু’টো কারণে হাতের মুঠোয় সাফল্য পেয়েও আমরা তা ধরে রাখতে পারি নি। প্রথমত জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতা, দ্বিতীয়ত আমাদের গণজমায়েত করার ব্যর্থতা। আমাদের বিপ্লবের মিলিটারি ডাইমেনশনটা সাক্সেস্ফুল হলেও সিভিল ডাইমেনশনে আমরা ফেইল করে গেছি।”
৭ নভেম্বরে ফুঁসে ওঠা ঐ বিদ্রোহ জাগিয়ে দেওয়ার পেছনে জাসদের কিছু মূল লক্ষ্য ছিল। আর তা হল- জাসদ বুঝতে পেরেছিল সাংগঠনিক দিক থেকে তারা ক্ষমতা দখলের উপযোগী অবস্থায় নেই। তাদের অনেক কর্মীই তখন কারাগারে। ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল কারাগার থেকে তাদের নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকদের মুক্ত করা, তারপর এস্টাবলিশমেণ্টের শরীক হওয়া এবং রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষমতার সমান্তরাল কেন্দ্র তৈরী করা। জাসদ মনে করছিল যে, আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান না করেও ঘটনাপ্রবাহের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করার মতো যথেষ্ট ওজন তাদের আছে।এ অবস্থায় জাসদ তার গণসংগঠনগুলোকে সক্রিয় করা এবং সেনানিবাসে অনুগত সামরিক কমিটি গঠন করার মাধ্যমে নিচ থেকে এক ধরনের 'আধিপত্য' তৈরি করতে চেয়েছিল। এ সময় জাসদ আন্দাজ করেছিল সমর্থনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক ভিত্তি তারা প্রসারিত করতে পারবে। এদিক দিয়ে দেখলে অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে মৈত্রীর কৌশল অনুসরণের ব্যাপারে তারা প্রস্তুতই ছিল, যা সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য পূরণের উপযোগী একটি রাষ্ট্র তৈরির ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। আর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন হতে পারতো ঐ বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায়, যার জন্য হয়তো কয়েক মাস সময় লাগতো, আর এ সময়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় থাকতো।
কিন্তু তাহের বুঝতে পারেন এ মুহূর্তে জাসদের পক্ষে এরকম একটা পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দেবার মতো অবস্থা নেই। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের সময় জাসদের সাংগঠনিক প্রস্তুতি বিদ্রোহের ন্যূনতম লক্ষ্য পূরণের উপযোগী ছিল না। লিফশুলৎসের সঙ্গে আলোচনায় তাহের জোর দিয়ে বললেন, ঘটনার গতিধারাই তাদেরকে আগেভাগে এ্যাকশনে যেতে বাধ্য করেছে। তিনি বললেন, তাদের নিজেদের হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী একেবারে আঁটঘাট বেঁধে প্রস্তুত হওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছতে, প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে ১৯৭৬ সালের মার্চ বা এপ্রিল পর্যন্ত সময় লেগে যেত। অর্থ্যাৎ, আরো ছয় মাস অপেক্ষা করলে ততোদিনে শহরে এবং গ্রাম এলাকায় তারা তাদের জনসমর্থন নতুন করে সাজাতে পারতেন।তাহের যুক্তি দেখালেন, একটার পর একটা অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থান সশস্ত্রবাহিনীকে গভীরভাবে অস্থির করে তুলেছিল। এর কারণ, সামরিক বাহিনীর সবাই বুঝে গেছে যে, সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে একপক্ষের উপর আরেক পক্ষের বাড়তি সুযোগ-সুবিধাই কেবল প্রতিষ্ঠিত হয়, দেশের যে হতদরিদ্র সিংহভাগ মানুষ, তাদের ক্ষেত্রে তা কোন মৌলিক পরিবর্তন আনে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা ব্রিগেডের মাধ্যমে কমরেড তাহের বারবার যে বাণীটি প্রচার করতেন তা হলো-একজন সৈন্যের পক্ষে দেশপ্রেমের প্রকৃত অর্থ হলো সবকিছুর উর্দ্ধে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণীটিকে তুলে ধরা। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের এক দরিদ্রতম দেশে এই বাণী সামরিক বাহিনীর রাজনীতি সচেতন অংশটির মধ্যে বিপুলভাবে জায়গা করে নিয়েছিল। এই রাজনীতি সচেতন শক্তিটিই তাহের এবং জাসদকে বিদ্রোহে নেমে পড়তে চাপ দিয়েছিল। নিঃসন্দেহে, এমনকি তুখোড় পর্যালোচনা সত্ত্বেও, তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। মনে করা হচ্ছিলো, তারা অংশগ্রহণ করুন আর নাই করুন একটি বিদ্রোহ অত্যাসন্ন। জাসদের সামনে তখন এ বিদ্রোহে ভ্যানগার্ড হিসেবে অবতীর্ণ হওয়ার অথবা না হওয়ার প্রশ্ন। তারা তখন ভ্যানগার্ড হওয়ার মতো উপযোগী অবস্থানে ছিল। ফলে তারা বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থেকে পথনির্দেশ দিয়েছে। সম্ভবত তারা এমন এক সমাজে বসবাস করতে করতে অধৈর্য হয়ে পড়ছিল যেখানে সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ানো লোকেরা শেষ পর্যন্ত আরাম কেদারায় দোল খায়, না হলে বাজারে চায়ের ষ্টলে বসে আলোচনার ঝড় তোলে।
এগার তারিখ পর্যন্ত জিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগাযোগ থাকলেও বার তারিখের পর সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেই জিয়া তাহেরকে এড়িয়ে যেতেন। একটা সফল বিদ্রোহের জন্য যে সব দুরুহ এবং জটিল দায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণে প্রস্তুতি ছিল কি না, এপ্রসঙ্গে ১৫ নভেম্বর ১৯৭৫ লিফশুলৎসের সাথে কথোপকথনে তাহের জানান, অভ্যুত্থানের সময় নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুবই জটিল ছিল। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর জোটবদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা ছিল এবং তারা অভ্যুত্থানের সমর্থকদের খতম করার অভিযানে নামতে পারতো। প্রতিশোধ স্পৃহার অভিপ্রকাশ হিসেবে পরবর্তী তিন বছরে সেটাই ঘটেছে। অপরিণত ও অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এরকম পরিণতিই বয়ে আনে।
এর সপ্তাহখানেক পর এক বৈঠকে তাহের ইঙ্গিত করলেন, ব্যাপক গণ-সমাবেশ, যেটা তিনি আশা করেছিলেন, তাতে জাসদ সাংগঠনিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে এসে সিপাহীদের স্বতস্ফুর্তভাবে অভিনন্দিত করলেও, অতীতে যেমন ছাত্র-জনতা-রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যাপক আলোড়ন দেখা গেছে, এক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। ৪ ও ৫ নভেম্বর জাসদের আন্ডারগ্রাউন্ড নেতৃত্বের এক বৈঠকে ঐসব শক্তিগুলোকে সক্রিয় করে তোলার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। তবে দায়িত্ব প্রাপ্তরা পরে যথেষ্ট আন্তরিকতা ও তৎপরতা নিয়ে মাঠে নামেনি। অভ্যুত্থানের বেশ কয়েকটি দিক ছিল। কেবল যে সামরিক শক্তিকেই সংগঠিত করা হয়েছিল তা নয়, ছাত্র-কর্মীদেরও বিষয়টি জানানো হয়েছিল এবং তাদের সংগঠিত ঐক্যের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছিল। লক্ষ্যনির্ভর বিদ্রোহের হাতকে মুষ্টিবদ্ধ করতে হলে সকল আঙ্গুলকে তো একসঙ্গেই গুটাতে হয়।
পূর্বধারণা অনুযায়ী কেন সংগঠিত সমর্থন পাওয়া যায়নি সে ব্যাপারেও যথেষ্ট বির্তক রয়েছে। ১৯৭৩ ও ৭৪ সালে যে সংগঠনটি লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়েছে, তাদের পক্ষে এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মকান্ড সামর্থ্যরে বাইরে থাকার কথা ছিল না। ৭ নভেম্বরের সকালে জাসদ পরিস্কারভাবে তাদের কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেনি, যা অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার এবং বিদ্রোহকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার সুযোগ করে দেয়। জনগণের একটি বড়ো অংশ তখন পর্যন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, অভ্যুত্থানের নায়ক আসলে কারা এবং তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, নীতিই বা কি, যদি তা আদৌ থেকে থাকে। কয়েকটি স্লোগানই যথেষ্ট ছিল না। এতে কোনো সন্দেহ নেই, সমাজতান্ত্রিক ধারার কোনো সংগঠনের পক্ষে এগুলো খুবই মারাত্মক ব্যর্থতা।
২৩ নভেম্বর পুলিশের একটা বড় দল কর্নেল তাহেরের বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেণ্ট আবু ইউসুফ খানের বাড়ী ঘেরাও করে ও তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় মেজর জেনারেল জিয়াকে টেলিফোন করলে অন্য প্রান্ত থেকে সেনাবাহিনীর উপ.প্রধান মেজর জেনারেল এরশাদ আমার কথা শুনে বলেন যে, আবু ইউসুফ গ্রেফতারের ব্যাপারে সেনাবাহিনী কিছুই জানে না। ওটা হচ্ছে একটা সাধারণ পুলিশী তৎপরতা। তখন একই সময়ে মেজর জলিল ও আ.স.ম. আব্দুর রব সহ অন্যান্য অনেক জাসদ নেতা ও কর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। ২৪শে নভেম্বর এক বিরাট পুলিশ বাহিনী কর্নেল আবু তাহেরকে ঘিরে ফেলে। তাকে জিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে একটা জিপে তুলে সোজা জেলে নিয়ে আসা হয়। জিয়া শুধু তাহেরের সাথেই নয়, বিপ্লবী সেনাদের সাথে, সাত নভেম্বরের চেতনার সঙ্গে, এক কথায় গোটা জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে। আর তার এহেন চরিত্র কেবল মাত্র মীর জাফরের সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ। এরপর ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই একটি গোপন সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচার করা হলো। বিচারে কর্নেল তাহেরসহ ১৭ জনকে শাস্তি দেওয়া হলো। তাহেরকে দেওয়া হলো মৃত্যুদণ্ড। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তথাকথিত রায়টি ঘোষিত হওয়ার মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ২১ জুলাই দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হলো। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হলো। বাঙালির এই জাতীয় বীর বিন্দুমাত্র শঙ্কাবোধ করেননি ফাঁসির মঞ্চে উঠতে।
এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, দেশের স্বাধীনতার জন্য কর্নেল তাহেরের মতো আরো যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বাংলাদেশের জনগণকে যেন আর কখনো নিজ দেশে ক্রীতদাসে পরিণত হতে না হয়, সেজন্য ঐ দৃষ্টিভঙ্গিটা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশ বীরের জাতি। যার প্রমাণ এই জাতি রেখেছে যুগে যুগে। দেশ গড়ার ক্ষেত্রে ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের শিক্ষা ও দিক নির্দেশনা পৌছে দিতে হবে আপামর জনসাধারণের মাঝে, যা ছিল প্রকৃত জাতীয় মুক্তির ডাক। কমরেড তাহের হয়ত আমাদের মাঝে স্বশরীরে অনুপস্থিত, কিন্তু তিনি আছেন তাঁর দেখানো আদর্শের মাঝে, প্রতিটা বিদ্রোহের মাঝে, এজাতির প্রাণে মিশে আছেন তাহের। যতদিন রবে মুক্তিকামী মানুষ, ততদিন রবে ৭ই নভেম্বরের চেতনা সমান উজ্জ্বল.....
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক!
দীর্ঘজীবী হউক স্বদেশ!
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)